শিক্ষার্থীরা সরকারবিরোধী পোস্ট দিতে পারবে না, তাহলে ছাত্র রাজনীতি কেন?

শিক্ষার্থীরা সরকারবিরোধী পোস্ট দিতে পারবে না, তাহলে ছাত্র রাজনীতি কেন?

কামরুল হাসান মামুন


ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিবাদীদের মাঝেও আমি দুটো পক্ষ দেখছি। এর একটি পক্ষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে কিন্তু তাদের প্রতিবাদ যেন কেবল দুজন (আসলে একজন) মানুষের বিরুদ্ধে।

এই পক্ষটি আবার একই সাথে অন্য প্রতিবাদী অংশটিকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যাদের সাথে আবার আমাদের পুলিশ বাহিনীও আছে। কয়েকদিন আগে আমরা দেখেছি কয়েকজন ছাত্র যখন ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি লিখছিল তখন পুলিশ তাদের ভ্যানে থানায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছে। বড় আজব দেশ বাংলাদেশ।

গতকাল আবার একটি প্রজ্ঞাপন দেখলাম যে সরকারবিরোধী বা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে এমন পোস্ট লাইক বা শেয়ার দিতে বারণ করা হয়েছে কলেজ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তাহলে ছাত্র রাজনীতি কেন? ছাত্র রাজনীতি কি কেবল কেবল সরকারকে প্রটেকশন দেওয়ার জন্য লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করা?

কেবল সরকারের গুণগান জন্য? ঠিক যেমন উপরের তথাকথিত ধর্ষণবিরোধী যে অংশটি সীমিত পরিসরে লোক দেখানো প্রতিবাদ করে আর আসলে ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদকে থামিয়ে দেয় সেইরকম কাজের জন্য ছাত্র রাজনীতি?

কোথাও কেউ অন্যায় করলে বা সরকারও যদি অন্যায় করে কেন লিখবেনা? কেন প্রতিবাদ করবে না? ঐতিহাসিকভাবেই সমাজ বা দেশের সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছাত্র শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ব। সেই প্রতিবাদ দলান্ধ হয়ে নয়। শিক্ষকরা হলো মানুষ ও জাতি গড়ার কারিগর যারা সমাজের গতি প্রকৃতি অন্য যেকোন প্রফেশনের মানুষের চেয়ে বেশি বুঝে বা বোঝা উচিত। বুঝে বলেই প্রতিবাদ করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।

এইজন্যই সত্যজিৎ রায় তার হীরক রাজার দেশেতে একজন শিক্ষককে সমাজ বিশুদ্ধিকরণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিটির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে কেবল একটি চরিত্র ছাড়া মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। যেই একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি তিনি হলেন শিক্ষক। এ দ্বারা বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ।

আর শিক্ষকরা যখন সত্যিকার অর্থেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে তখন কি তাদের ছাত্ররা বসে থাকবে? তাহলে কেন ছাত্র-শিক্ষক লিখবেনা? কেন অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে না? বস্তুনিষ্ঠ যে কোনকিছু নিয়ে এরা দেয়ালে লিখবে, গ্রাফিতি লিখবে, প্ল্যাকার্ড লিখবে, পোস্টারে লিখবে, পত্রিকায় লিখবে, কার্টুন আঁকবে, রম্য গল্প লিখবে ফেসবুবে লিখবে, টুইটারে লিখবে, বই লিখবে।

১৯৫২ সালের ছাত্র শিক্ষকদের যদি প্রতিবাদ করতে না দিত? ১৯৭১ সালে এ পুলিশ-সিপাহিরা যদি সরকারী কর্মচারী বিধি মেনে চলতো? ছাত্র-জনতা যদি সুবোধ বালকের মতো আচরন করত এবং রুখে না দাড়াতো তাইলে কি আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ হতোনা। এই সরকার যখন বিএনপি জামাত সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তখন কি ছাত্র শিক্ষক প্রতিবাদ করেনি? এমন কি সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও সরকারি চাকুরীবিধি ভঙ্গ করে জনতার মঞ্চে গিয়েছিল।

একইভাবে বঙ্গবন্ধু যদি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অন্যায় নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপনগুলো নিরীহ মানুষ হিসেবে মেনে চলতেন তাহলেও এই বাংলার জন্ম হতোনা । আমার সত্যিই অবাক লাগে এই ভেবে যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এইরকম বাক স্বাধীনতা হরণকারী প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশনা কেমন করে পয়দা হয়? সরকার কি চাচ্ছে যে দেশে একটি ক্যাস্ট্রেটেড বলদ প্রজন্ম তৈরী হোক যাদের একমাত্র কাজ হবে সরকারের গুণগান করা আর তাদের প্রটেকশন দেওয়া?

এই সরকার নাকি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তেছে! What a joke!

ফেসবুক থেকে…


লেখক
কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *