শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য কি আমাদের শিক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না?

শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য কি আমাদের শিক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে না?

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম


গত কয়েকদিন ধরে একটা নিউজ বেশ আলোচনায়। বিষয়টি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ও এমফিলের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি নিয়ে। জানি না এটা নিয়ে আলোচনা এইবার কেন, এই বিজ্ঞপ্তিতে একই ভাষা ও নীতি বহুবছরের ছিলো। বোধ করি, এবার প্রথম আলো সহ মিডিয়ায় ভর্তি বিজ্ঞপ্তি কাভার হয়েছে বিধায় এটা আলোচনায় আসছে।

আলোচ্য বিষয় দুটি এই ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে
১. প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র সরাসরি পিএইচডি ‘তে ভর্তি হতে পারবে না;
২. পিএইচডি ও এমফিল ভর্তিতেও স্কুল কলেজের রেজাল্ট এর শর্ত

হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, দুনিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয়(বাংলাদেশের ছাড়া) এরকম আজগুবি শর্ত দেয় না।এগুলো রীতিমতো ‘হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য!তবে, হয়তো এই শর্ত ঢাবি প্রকাশ্যে উল্লেখ করেছে, কিন্তু অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়তো লিখে দেয় না।কিন্তু তারা অলিখিতভাবেই এটা বিধিবদ্ধ করে নিয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

এখন প্রশ্ন হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা করতে পারে কিনা?
উত্তর সহজ, প্রথমত,এগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইনগতভাবে সবই পারে ও বিধিবদ্ধ! বিশেষ করে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অর্ডিন্যান্সে হয়তো শুধু একজনকে পুরুষ থেকে মহিলা রুপান্তর করতে পারে না বাকি সব পারে।
১৯৭৩ এর অর্ডিন্যান্স অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো। কিন্তু আমরা এর যোগ্য কিনা সেই প্রশ্ন বরাবরই জ্বলজ্বল করে! কারণ শিশুদের হাতে উপকারী বস্তুও তাৎপর্যপূর্ণ নয়।এগুলোর মর্ম বোঝার জন্য ‘বড়’ হতে হয়!এই স্বায়ত্তশাসনের নামে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এরা একেকটি মগের মুল্লুক বানিয়ে ফেলেছে।পত্রিকা খুললেই তাদের লজ্জাস্কর নিউজগুলো হরহামেশাই চোখে পরে।

লেখকের আরও কলাম-

এইচএসসি বিনা পরীক্ষায় পাশের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা : একটি মূল্যায়ন

দ্বিতীয়ত, নৈতিক ভাবে এরা এটা করতে পারে কিনা? না, নৈতিকতার প্রশ্নে তারা মোটেই এইসব করতে পারে না।পারে না এই কারণে এগুলো জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে,তাই জনগণের বৃহৎ স্বার্থে এরা কাজ করবে এটা প্রত্যাশিত। তাদের কাজগুলো রাষ্ট্রকে সঠিক বার্তা দিবে এটাই প্রত্যাশিত।

এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত আদালতে রিট করা! চাইলে সংক্ষুব্ধ কোন ছাত্র বা আইনজীবীও রিট করতে পারেন। রাষ্ট্রের সচেতন সমাজের উচিত এরূপ পাড়া-মহল্লার মাতবরদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে সোচ্চার হওয়া।কারণ সমাজে এর ভুল বার্তা যাচ্ছে আর দেশের সংবিধান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্বীকার করে কার্যত রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই শতবর্ষ উদযাপন করলো,আর কত শতবছর গেলে স্কুলের বাচ্চাদের মত আচরণ বন্ধ করবে? শতবর্ষ পেড়িয়ে গেলেও এখন পিএইচডি ভর্তি থেকে স্কুলের রেজাল্ট এর বিবেচনার মত হাস্যকর শর্ত থেকে সরে আসতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি।আরো মজার বিষয় এই ধরনের বিজ্ঞপ্তিতে প্রায়ই বলা থাকে, আভ্যন্তরীণ প্রার্থীদের জন্য যেকোন শর্ত শিথিলযোগ্য! দুনিয়ার আর কোন দেশে এরকম ‘হাস্যকর’ শর্ত আছে কিনা জানি না।

প্রসঙ্গত, ইউজিসি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিএইচডি ও এমফিল প্রোগ্রাম চালু করার সুযোগ দেয় না, যা অবশ্যই সংবিধানের ২৮(১) এর সাথে সাংঘর্ষিক। যেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাটাস সরকার ও ইউজিসি অনুমোদিত,সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন অধিকারই নাই এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করা! অনেকে শুধু নিয়ম বলে চুপ করে আছেন।আরে যে নিয়ম আপনার অধিকারকে সমুন্নত রাখে না সে নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করতেই হবে,সেটা হউক গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে! এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির নিজেদের অক্ষমতার দায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে খোড়া যুক্তিতে।মোটাদাগে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম থেকে বিরত রাখার কোন সুযোগই নেই তাদের।তারা বিভিন্ন শর্তারোপের মাধ্যমে অবশ্যই তার অনুমতি ‘যোগ্য’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেয়া উচিৎ। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি বাংলাদেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রাম চালু করার সক্ষমতা এই দেশের কথিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেক বেশিই আছে।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করে বৈষম্যমূলক পোষ্য কোটাও চালু রেখেছে যা ভর্তি থেকে শিক্ষক নিয়োগেও প্রযোজ্য হয়।এখানে আরেকটি আলোচনা প্রাসঙ্গিক- এই বৈষম্য কি শুধু ঢাবিই করে? উত্তর- না! শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নয়, স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। স্কুল পর্যায়ে সাধারণত জেলার সেরা স্কুল থাকে জেলা স্কুলগুলো!গ্রাম থেকে যেসব ছেলেরা এই স্কুলগুলোতে পড়তে আসে তাদেরকে গেরাইম্যা বলা হয়!

কর্মক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান রীতিমতো নাম উল্লেখ করে যোগ্য-অযোগ্য ঘোষণা করে দেয়!চাকুরীতে অনেক প্রতিষ্ঠান রীতিমতো বুলি করে চাকুরী প্রার্থীদের তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ ২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়েও চাকরি না পাওয়া কুমিল্লার আবদুল আউয়াল।১ম হয়েও আউয়ালের ২৯তম বিসিএসের প্রার্থিতাই শুধু বাতিল হয়নি এবং সরকারি চাকরিতে তাঁকে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন পিএসসি। তখন পিএসসি বলে, ‘আউয়ালের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথম হওয়ার মতো নয়।’ কিন্তু কীভাবে তিনি প্রথম হলেন, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত করেনি পিএসসি। বরং সব সিদ্ধান্তই প্রথা ভেঙে গোপন রাখা হয়েছে।এখন জানি কি সেই গোপন কারণ যে কারণে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হলো!

২৯তম বিসিএস পরীক্ষায় শীর্ষ দশে যাঁরা আছেন, তাঁদের নয়জনই কোনো না কোনো বিষয়ে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে।কিন্তু একমাত্র আবদুল আউয়ালই পাস কোর্সে (ডিগ্রি) পড়েছেন, মাস্টার্স করেছেন। আর তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ!

২০১৫ সালে চাকরিতে নিষিদ্ধ হওয়ার পরে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে জিতে অবশেষে বিসিএস ক্যাডারে চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয় মেধাবী শিক্ষার্থী আব্দুল আউয়াল। তাকে পুলিশে চাকরির জন্য মনোনীত করেছে পিএসসি।অবশ্য নিয়োগেও শুনেছি গড়িমসি, পরে জয়েন করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না।আর যদি জয়েন করেনও এতগুলো বছর আর হয়রানীগুলো তাকে কে ফিরিয়ে দিবে?প্রসঙ্গত,২০০৯ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় ২৯তম বিসিএসের কাজ।২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৯তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে। সেবার মোট ৫ হাজার ৬২ জন চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন।

তাদের মধ্যে ১ হাজার ৭২২ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে পদায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়।সেখানে ১ম হয়েছিলেন আওয়াল।পরে প্রথম হবার পর ওনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ডিগ্রি পাস হওয়া দেখে কমিশন সন্দেহ করে তার ফলাফল আর সন্দেহের থেকেই তাকে আবার মূল্যায়নের জন্য ভাইভাতে ডাকে। তারপর তাকে অবমূল্যায়ন করে ও চাকুরীতে নিষিদ্ধ করা হয়।এত বড় একটা বিসিএস পরীক্ষার তিন ধাপের আয়োজনে কেউ জালিয়াতি করে না হয় চাকুরী পেতে পারে,কিন্তু সে কি প্রথম হতে পারে?আব্দুল আওয়াল যদি আজকে ঢাবি,রাবি,চবির ছাত্র হতো হয়তো এই প্রশ্নই আসতো না!!

এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ সংবিধানের ২৮(১) ও ৪৪ ধারার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।এই ধারাদ্বয় এরুপ বৈষম্যকে নিরুৎসাহিত করে।তাই সচেতন সমাজের উচিত এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা! না হলে নিভৃতে বৈষম্যের জাঁতাকলে বহু মেধাবী প্রতিষ্ঠানের নামে পিষে যাবে,ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতি।

মোহাম্মাদ ফখরুল ইসলাম
শিক্ষক
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও
মানবাধিকার কর্মী ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *