সাবমেরিন রাজনীতি : ভূ-রাজনীতির কবলে বঙ্গোপসাগর

সাবমেরিন রাজনীতি : ভূ-রাজনীতির কবলে বঙ্গোপসাগর

মোঃ আশরাফুল আলম আকাশ

অনেক আগে মার্কিন এক অর্থনীতিবিদ তার লেখা এক কলামে বলেছিলেন, ” সমুদ্র যার বিশ্ব তার”।
বিংশ শতাব্দীর দিকে এসে আমরা তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি। কারণ বিশ্ব বানিজ্যের ৯০ শতাংশ পণ্য আমদানি-রপ্তানী হয় এই সমুদ্র পথেই। সমুদ্রের এ বানিজ্য নীতি শুধু মাত্র এখন আর বানিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং এর বিস্তৃত হয়েছে সামরিক ক্ষেত্রে তথা বৈশ্বিক ও আন্ঞ্চলিক ভু-রাজনীতিতে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে সমুদ্র রাজনীতির ধাক্কা বঙ্গোপসাগরে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অনেক আগে থেকেই বিশ্ব মোড়লদের নজর ছিল এই উপসাগরে। বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রত্যক্ষভাবে এই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে।সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার এর সাবমেরিন রাজনীতি যেন ব্যাপারটিকে আরো জটিল করে তুলেছে।

সময়টা খুব বেশি দিনের নয়। ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে এবং ২০১৪ সালে ভারত থেকে বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল যা দেশটির সমুদ্র সম্পদ অন্বেষণ এবং এর সঠিক ব্যবহারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যার ফলে দেশটির সমুদ্র সীমান্ত রক্ষার জন্য নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। এরই অংশ হিসাবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বহরে যুক্ত হয়েছে চীনের ব্যবহৃত দুটি সাবমেরিন ” নবযাত্রা” ও ” জয়যাত্রা”।

তবে আসল কথা হলো বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয় বঙ্গোপসাগরের রাজনৈতিক পেক্ষাপট যেন আরও জটিল করে তুলেছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কাছে। কারণ বাংলাদেশ এমন একটা সময় সাবমেরিন ক্রয় করলো যখন কিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমার এর সাথে সামরিক উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌছিয়েছে।
কিছুদিন পরে খবর এলো মিয়ানমার স্বল্প মাত্রার হালকা টর্পেডো নিতে যাচ্ছে ভারত থেকে এবং ভারত ২০১৭ সালে মিয়ানমার নৌবাহিনীকে টর্পেডো সরবরাহ করেছিল। এবছর মিয়ানমার ভারত থেকে aবারও একটি সাবমেরিন ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যা ভারত রাশিয়া থেকে ক্রয় করেছিল ১৯৮৮ সালে।

এখন আসল বিষয় পর্যালোচনা করা যাক, বাংলাদেশ -মিয়ানমার এর সাবমেরিন রাজনীতি কি আসলেই শুধুমাত্র দেশ দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ? প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ-মায়ানমার এর সামরিক উত্তেজনা চলমান এটা ঠিক তবে পর্দার উল্টো পিট হলো বাংলাদেশ -মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে চীন-ভারতের সামরিক অধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলসীমানায়। শুধুমাত্র ভারত-চীন নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের এই উপসাগরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলমান।

চীন ইতিমধ্যে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। শ্রীলঙ্কার একটি বন্দরও তারা ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। এমনকি মালদ্বীপ এর একটি দ্বীপ তারা ৫০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সেখানেও তারা সামরিক কার্যক্রম চালাতে পারে। বঙ্গোপসাগর ঘিরে চীনের এ আগ্রাসী মনোভাব ভারতকে নতুন করে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে ভাবতে বাধ্য করছে। তাই যখন বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্রয় করলো ঠিক তখন সাবমেরিন বিষয়ে মায়ানমার এর ও আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। তাই মায়ানমার যাতে আবার চীনের কাছে সাবমেরিন না নেন এজন্য তড়িঘড়ি করে ভারত মিয়ানমারকে সাবমেরিন দিতে চুক্তি করলো।

বাংলাদেশে সাবমেরিন ঘাঁটি তৈরির কাজও পেয়েছে চীন। তাই ভবিষ্যতে চীন যে ভারতের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে পারে সে সম্ভাবনা ভারত একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছে না। ভারত – চীন উভয় দেশই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ সামরিক ও অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তার কারণ ভৌগোলিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এ রয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তাই দেশ দুটি যার পক্ষে থাকবে তার জন্য বঙ্গোপসাগরে প্রভাব বিস্তার সহজ হবে। তাই চীন-ভারত ভু-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নতি যে বিশ্বের বড় বড় বিনিয়োগকারী দেশকে আকৃষ্ট করেছে তা সাম্প্রতিক খবরগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ইতিমধ্যে বলেই দিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের সাথে আলাদাভাবে সম্পর্ক গড়তে চায়। বাংলাদেশের সাথে ভারত বা চীন এর কেমন সম্পর্ক তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই বরং তারা বাংলাদেশের সাথে উজ্জীবিত সম্পর্ক স্থাপন এ আগ্রহী। এর আগেও তারা বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি করার প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ অবশ্য প্রস্তাবটি নাখোশ করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্রেও বঙ্গোপসাগরের উপর নজর রাখতে চায়।

চীন-ভারত বা অন্যান্য বিশ্ব মোড়ল রাষ্ট্রগুলো যে অনেক আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরের রাজনীতিতে জরিয়ে পড়েছে তা সকলেরই জানা। বর্তমান সময়ে তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ-মিয়ানমার এর সমুদ্র রাজনীতি এখন চোখে পড়ার মতো। রোহিঙ্গা ইস্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত ২ বার মিয়ানমার তাদের মানচিত্রে সেন্ট মার্টিন কে যুক্ত করেছিল। বাংলাদেশ তাদের এ কর্মকাণ্ড কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় বঙ্গোপসাগর ঘিরে ভু-রাজনৈতিক অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে।

প্রত্যকটি দেশ নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলছে। বাংলাদেশও সেই পথেই হাঁটছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল জলরাশি। বঙ্গোপসাগরের এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ একদিন উন্নতির চরম শিখরে উঠবে বলে আমরা বিশ্বাসী। তাই “সবার সাথে বন্ধুত্ব,কারো সাথে শত্রুতা নয়” এ-ই নীতিকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবেই আমরা বঙ্গোপসাগর ঘিরে আমাদের অর্থনীতির নতুন সম্ভবনা দাড় করতে পারবো।

লেখক
মোঃ আশরাফুল আলম আকাশ
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *