সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বনাম বাস্তবতা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বনাম বাস্তবতা

অনিক চৌধুরী তপু


আজকের এই বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সাইট গুলো দিন থেকে দিন সহজ থেকে সহজতর হয়ে যাচ্ছে। এই সহজতর হওয়ার ফলে একটি ঘটনা ঘটার সাথেই তা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে। শুরুর দিকে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। এর মাধ্যমে দূরে থাকা পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায় বলে এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। তখন থেকেই এটাকে আমরা ইতিবাচক ভাবেই নিয়েছি।

তবে বর্তমানে এর মাত্রা একটু বেড়েছে। শেয়ার করা কিছুতে যত বেশি লাইক, তত বেশি ভালোলাগা কাজ করে সবার মধ্যে। নিউজ শেয়ার করা হলে সেটারও প্রসার বাড়ছে। আবার এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। উসকানি দিতে চায়— এমন ব্যক্তি বা নিউজ পোর্টাল ভুল তথ্য, বা ভুল খবর হেডলাইন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে, তখনও সেটাও ছড়িয়ে পড়ে দ্রুতগতিতে। আবার অনেকে ওইসব নিউজের হেডলাইন পড়েই কমেন্ট করে বসছেন, নিউজটি খুলে পড়েনও না।

সাম্প্রতিক কালে ফেসবুক টুইটার এই ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং যারা পাঠক বা দর্শক আছেন তারা গুজবটাকেই সত্যি খবর থেকে বেশি গ্রহণ করছেন। এই ধরুন না ২০১৬ সালের মার্কিন ইলেকশনের কথাটাই। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ফেসবুকের ভুয়া খবর বিশেষ প্রভাব রেখেছে। এইসব ভুয়া খবরে জনমত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যেমন, বার্তা সংস্থা বাজ-ফিড নিউজের মতে নির্বাচনের আগের শেষ তিন মাসে ২০-টি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ভুয়া খবরের সাইটগুলোর খবর শেয়ার করা, সেগুলোতে মন্তব্য করা, প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন বার, অথচ নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ইত্যাদি সহ নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর শেয়ার করা, মন্তব্য করা, প্রতিক্রিয়া জানানো ইত্যাদি হয়েছে ৭.৩ মিলিয়ন বার।

অর্থাৎ, ভুয়া খবর জনগণের মতামতকে অন্যদিকে টেনে নিয়েছে, যার ফলাফল নির্বাচনে প্রকাশিত হয়েছে- হিলারি যাবতীয় জরিপে এগিয়ে থাকলো নির্বাচনে জয়ী হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প, এবং অনেক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন এর পেছনে রয়েছে ফেসবুকের ভুয়া খবরের প্রভাব। এইসব ভুয়া খবরে একজন নারী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনকে অবমাননা করা হয়েছে, তাকে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে; অর্থাৎ যে সাধারণ মানুষ খুব বেশি সচেতন নয় সে এইসব খবর পড়ে খুবই প্রভাবিত হওয়ার কথা, এবং তাই হয়েছে বলা চলে।

সাম্প্রতিক কালে ফেসবুক টুইটার এই ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং যারা পাঠক বা দর্শক আছেন তারা গুজবটাকেই সত্যি খবর থেকে বেশি গ্রহণ করছেন।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে-ও সংবাদ আহরণের প্রধান মাধ্যম ফেসবুক। তাই এদের কাছে ভুয়া খবর, গুজব পরিবেশন করা হলে তা চক্রবৃদ্ধিহারে সামাজিকভাবে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর প্রভাব টের পাওয়া যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ায়। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ভুয়া খবর ও গুজবের প্রতি সরকারের যেমন মনোযোগ দেয়া দরকার তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর-ও সজাগ থাকা দরকার কীভাবে এই ভুয়া খবর ও গুজবকে ব্যবহার করে জনমতকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং সাম্প্রতিক কিছু বিপর্যয়ে ফেসবুক কেন্দ্রিক ভুয়া খবরের ভাইরাল হওয়া দায়ী। শাহবাগ আন্দোলন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় বাঁশের কেল্লাসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেক ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পাতা থেকে বিকৃত এবং অসত্য খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো শাহবাগ আন্দোলনকে ধর্মীয় দিক থেকে আক্রমণ করার, জনমত প্রভাবিত করা, এবং ভুয়া খবরের মাধ্যমে মানুষের মনে ঘৃণা, আগ্রাসন ইত্যাদি নেতিবাচক অনুভূতি ও মেজাজকে উসকে দেয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অনেক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বিকৃত খবর ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা ছিল।

কয়েক বছর আগের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক হামলা যা নাসিরনগরে ঘটেছিল, এবং অনেক হিন্দু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল সেটি কিন্তু ছিল ফেসবুক কেন্দ্রিক এবং এক্ষেত্রে নানা মৌলবাদী ও ধর্মীয় উন্মাদনায় লিপ্ত থাকা অনেক পাতা থেকে বিকৃত তথ্য ও ভুয়া খবর ভাইরাল করে মানুষকে উসকে দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে এক হিন্দু যুবক কাবা শরিফকে হেয় করে ছবি প্রকাশ করেছে অথচ সেই হিন্দু যুবকের না ছিল প্রযুক্তি বিষয়ক যথেষ্ট জ্ঞান; অর্থাৎ ভুয়া খবরকে ভিত্তি করে অনেকে তাদের কূটকৌশল ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপ দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও স্বাধীনতাবিরোধী। রোহিঙ্গাদের নিয়েও প্রকাশিত, প্রচারিত হচ্ছে নানা ভুয়া ছবি ও খবর, যার উদ্দেশ্য নানাবিধ। এছাড়া, যেকোনো ধর্ষণ, অপরাধ, নির্যাতন, চলতি খবর ইত্যাদি ঘিরে প্রকাশিত ও পরিবেশিত হয় বা হচ্ছে নানা ভুয়া খবর ও গুজব। এইসব ভুয়া খবরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার অন্যান্য দেশের মতো ফেসবুককে অনুরোধ করতে পারে কিংবা আইনের আওতায় আনতে পারে, কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটে তবে তার জন্য কে দায়ী হবে এইসব নির্ধারণের সময় এসেছে।

ফেসবুক নিজেকে একটি সেবা হিসেবে দাবি করলেও এটি মূলত একটি ব্যবসা, এটি শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফেসবুক তার আয়ের প্রধান অংশ কামাই করে, তাই হয়তো এইসব ভুয়া খবরে ফেসবুকের আয়ের কমতি নয় বরং বাড়তি সম্ভাবনা থাকার কারণে ফেসবুক ভুয়া খবর নিয়ন্ত্রণে উদাসীন। তাই তাদের রাষ্ট্রীয় ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার সময় এসে গেছে।

সবশেষে প্রত্যেকটা জিনিসের একটা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে৷ এই সোশ্যাল মিডিয়া মানুষ যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু করেছিল এখন অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমরা কখনই বলি না- এগুলো ব্যবহার করা যাবে না৷ তবে ব্যবহারের একটা মাত্রা, সীমারেখা আছে৷ সেটি মেনে চলতে হবে৷ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে৷ তাতে সব সমস্যার সমাধান না হলেও, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে।


লেখকঃ শিক্ষার্থী,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *