স্প্যানিশ ফ্লু

স্প্যানিশ ফ্লু

আনন্দ কুমার সাহা


স্প্যানিশ ফ্লু কি? ভাইরাসজনিত এক ধরনের জ্বর। যারা অবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ভাইরাস সম্পর্কে হয়ত ভাল ধারণা নাও থাকতে পারে। ভাইরাস কি একটি জীব? ভাইরাসকে আমরা একটা আদর্শ কোষ ( Cell ) বলতে পারবো? এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোষ কি? আমরা প্রায় সবাই জানি জইঈ কি। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গভাবে এটাকে কি বলা হয়। Red Blood Corpuscles/Cell? এটা একটি কোষ নয়।

কোষ হচ্ছে যার একটি নিউক্লিয়াস থাকবে, একটা আবরণ থাকবে এবং কোন বস্তুর সহযোগিতা ছাড়াই বংশবিস্তার করতে পারে। জইঈ তৈরী হয় কিন্তু বংশবিস্তার করে না। ভাইরাস বংশবিস্তার করতে পারে কিন্তু সেজন্যে তার সহযোগিতার প্রয়োজন। যেহেতু ভাইরাস সহযোগিতা ছাড়া বংশবিস্তার করতে পারে না সেহেতু আমরা ভাইরাসকে একটি আদর্শ কোষ বলতে পারি না। এটি স্বাভাবিক অবস্থায় বালুর দানার মতো পরিবেশে অবস্থান করে থাকে। যখন ভাইরাস পোষক দেহ (host body) পায় তখনই বংশবিস্তার করতে শুরু করে।

স্প্যানিশ ফ্লু জানুয়ারি ১৯১৮ থেকে ডিসেম্বর ১৯২০ সাল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এসময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে ৫ কোটি মানুষকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। স্প্যানিশ ফ্লু-র উৎপত্তি কোথায়? প্রথম মহাযুদ্ধের সময় স্পেন নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলো- যার কারণে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো এবং তেমন কোন শর্তারোপ ছিল না।

১৯১৮ সালের মে মাসে মাদ্রিদে প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তখন থেকে এটাকে বলা হত স্প্যানিশ ফ্লু। অবশ্য পাখি থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয় বলে এর আরেক নাম এভিয়ান ফ্লু (HINI)। আমরা টেলিভিশনে প্রতিদিন করোনা ভাইরাসের ছবি দেখি। লম্বা-লম্বা স্পাইক দেখতে পাই HINIহচ্ছে সেই স্পাইক- H= হেমাগ্লুটানিন, N= নিউরোএমাইনিডেজ। HI- কোন বস্তুর সঙ্গে লেগে থাকার জন্য সহায়তা করে আর NI- হচ্ছে নিউরোএমাইনিডেজ যা কোন বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ভাইরাসগুলো মিউটেশনের কারণে HI এবং NI-র সংখ্যা পরিবর্তন করতে পারে। যার ফলে সহজেই কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

প্রকৃতপক্ষে আমেরিকায় ১৯১৮ সালের ১১ই মার্চ প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু ধরা পড়ে। ডাক্তাররা বুঝতে পারেনি কিভাবে স্প্যানিশ ফ্লুর আবির্ভাব ঘটলো, বা কিভাবে এর চিকিৎসা করা যায়। সে সময় কোন ভ্যাকসিন, এ্যান্টি ভাইরাল ড্রাগ যা ফ্লুকে প্রশমিত করে- কিছুই ছিলো না বা বিজ্ঞানও তখন বর্তমান সময়ের মত উন্নত ছিলো না। একারণে তখন ৫ কোটি লোক প্রাণ হারায়। মৃত্যুর হার শিশুদের মধ্যে বেশী ছিলো, তবে যুবক-বৃদ্ধ সবাই আক্রান্ত হয়েছিলো।

সে সময় কোয়ারেন্টাইন আরোপিত হয়েছিলো। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক, জনসমাগমপূর্ণ জায়গা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, মসজিদ, গীর্জা, মন্দির সবকিছুই বন্ধ ছিলো। বর্তমান সময়ের মতো হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। ঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছিলো। রাস্তা-ঘাটে থুথু ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এমনকি বয়েজস্কাউটরা রাস্তায় যাতে কেউ থুথু না ফেলে তার জন্য তারা স্বেচ্ছাশ্রমও দিয়েছিলো।

চিকিৎসার জন্য এ্যাসপ্রিন ব্যবহার করার নির্দেশনা ছিলো। প্রতিদিন ৩০ গ্রাম করে খাওয়ানোর নির্দেশ ছিলো, যা বর্তমানে কল্পনাও করা যায় না। মূলত ৪ গ্রাম করে এ্যাসপ্রিন খাওয়াও সঠিক নয়। অনেকে এ্যাসপ্রিন ওভারডোজে বিষাক্ত হয়ে মারা গিয়েছিলো।

এত মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো যে, হাসপাতাল, ব্যক্তিগত বাসা, স্কুল, কলেজকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো। বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ এর আক্রান্তে মৃতদের নিউয়র্ক সিটিতে দাফন করার জায়গা নেই। অনেক দূরে মৃত ব্যক্তিদের দাফন করা হচ্ছে। সে সময় অসুস্থতার সংখ্যা অনেক বেশী ছিল বলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি জমি থেকে ফসল কেটে আনার মতো লোক পাওয়া যায়নি। অর্থনৈতিকভাবে গোটা বিশ্ব পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিলো।

স্প্যানিশ ফ্লু-তে উল্লেখযোগ্য যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডী ১৯১৮ সালের ২২ই নভেম্বর তারিখে, ব্রাজিলের ২য় বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ১৬ই জানুয়ারি ১৯১৯, সাউথ আফ্রিকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ১৯১৯ সালের ২৭শে আগস্ট, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ২৬শে অক্টোবর ১৯১৮, জন হপকিনস্ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ১৯১৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর এবং আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদাও স্প্যানিশ ফ্লু-তে আক্রন্ত হয়ে মারা যান।

বর্তমান সময়ে আমরা রাষ্ট্রচালানোর জন্য একজন ভাল মাঝি পেয়েছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে- সেদিকে খেয়াল রেখে নৌকার মাঝি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করছেন। আশাকরি মেঘ অচিরেই কেটে যাবে এবং নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে বাংলাদেশ। জয় বাংলা।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *