হলি আর্টিজান হামলার চার বছর!

হলি আর্টিজান হামলার চার বছর!

মো: মিনহাজুল ইসলাম


বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক জঙ্গি হামলার ( হলি আর্টিজান) আজ চতুর্থ বার্ষিকী। নিহতদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে দিনটি এই করোনা কালে পালন করছেন দেশ – বিদেশে থাকা তাদের কাছের মানুষেরা।

২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ের সেই হামলা পরিচালনা করে পাঁচজন সশস্ত্র জঙ্গি। আর এতে নিহত হন ২ পুলিশ সদস্য সহ ২২ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক।

রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়াখ্যাত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি সবসময় দেশী-বিদেশী নাগরিকের পদচারণায় মুখরিত থাকতো।

অন্যান্য দিনের মতো ২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যার পরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে হলি আর্টিজান বেকারি। তবে সেই ১ জুলাই অন্য আর আট দশটা দিনের মতো ছিলো না। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেদিন এই হলি আর্টিজান বেকারি পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।

১ জুলাই ২০১৬ সন্ধ্যা নামতেই সেখানে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম জঙ্গি হামলা। প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধ শ্বাস জিম্মি অবস্থা ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতিকে।

হামলার পর পরই পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়,তবে স্পর্শকাতর বিবেচনায় সেই রাতে অভিযান চালানো থেকে বিরত থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর বিশেষ প্যারা কমান্ডো সদস্যরা পরিচালনা করে ” অপারেশন থান্ডারবোল্ট “। আর হতে অবসান হয় জিম্মি দশার, নিহত হয় ৫ জঙ্গি।

এর আগে হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ফোর্সসহ প্রথমে পৌঁছান গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস। মামলার এজাহারে ঘটনার বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন গুলশান থানার রোড নম্বর-৭১ থেকে ৯২ এবং এর আশপাশের এলাকায় পেট্রোল ডিউটির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

হলি আর্টিজানে কী ঘটেছিলো সেদিন?

রাত আনুমানিক পৌনে ৯টায় ওয়্যারলেসে ভেসে আসে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে গোলাগুলির খবর। খবর পেয়েই ফোর্সসহ রাত আনুমানিক ৮টা ৫০ মিনিটে ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে পৌঁছান এসআই রিপন। হলি আর্টিজানের কাছে উপস্থিত হয়ে তারা দেখতে পান, রেস্টুরেন্টের ভেতরে কতিপয় সন্ত্রাসীরা ‘আল্লাহ্ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করছে।

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ ও এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীদের নিক্ষিপ্ত গুলি ও গ্রেনেডের আঘাতে এসআই ফারুক হোসেন, কনস্টেবল প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন মারাত্মক আহত হন। আহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং এসআই রিপন কুমার দাস বিষয়টি তাৎক্ষণিক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।

যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিটের অফিসার ও ফোর্স ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়। এরপর পুলিশসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজানে বেকারির চারপাশ ঘেরাও করে ফেলে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে অনবরত গ্রেনেড ও গুলি বর্ষণ করতে থাকে।

এ অবস্থায় রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় সন্ত্রাসীরা হলি আর্টিজানের বেকারির পশ্চিম দিকের বাড়ির সামনে অবস্থানরত পুলিশ অফিসার ও ফোর্সদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আহত হন। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। আহতদের সবাইকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টা ২০ মিনিটে বনানী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান মৃত্যুবরণ করেন, এর কিছুক্ষণ পরই ডিবি’র সহকারী কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিমও নিহত হন।

এর মধ্যে পুলিশের আইজিপি ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, হলি আর্টিজানের ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশিও আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।

পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে রাতেই পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর কমান্ডোরারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তার স্বার্থে ঘটনাস্থলের পাশ থেকে গণমাধ্যমকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়।

রাত দেড়টার দিকে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী উল্লেখ করে পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এ তথ্য জানায়।

পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে ২ জুলাই সকাল আনুমানিক ৭টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন জিম্মিদের উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করার লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করে এবং ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

অভিযানে নিহত জঙ্গিরা হলেন- মীর সামহ মোবাশ্বের (১৯), রোহান ইমতিয়াজ (২০), নিরবাস ইসলাম (২০), খায়রুল ইসলাম পায়েল (২২), শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ (২৬)।

পরে জিম্মি থাকাবস্থায় সন্ত্রাসী কর্তৃক নৃশংসভাবে নিহত হওয়া ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি নাগরিক । ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানের, ১ জন ভারতের ও ৩ জন বাংলাদেশি।

সিআইডি ক্রাইম সিন বিভাগের সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্যাদিসহ ভিকটিমদের ব্যক্তিগত মালামাল জব্দ করে নিজ হেফাজতে নেয় পুলিশ।

উদ্ধারকৃত জিম্মিদের বয়ান অনুযায়ী তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জঙ্গিরা হামলার প্রথম ২০ মিনিটেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে/গলাকেটে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠায় তারা। তারা এতটাই নিষ্ঠুর ছিল যে, লাশের সারি মেঝেতে রেখেই খাবার খায়।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। অবশেষে বিচার শুরুর এক বছরের মধ্যেই আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করে আদালত।

হলি আর্টিজান কেনো টার্গেট হলো?

সিটিটিসির অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, প্রায় দেড় বছর আগে পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে নৃশংস এ হামলা সরাসরি বাস্তবায়নে দায়িত্ব দেওয়া হয় আত্মঘাতি পাঁচ জঙ্গিকে।

আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জেএমবির একটি গ্রুপ বিদেশিদের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরবর্তীতে ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি পাওয়া এ গ্রুপটির কথিত শুরা কমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় বৈঠক করে হলি আর্টিজানে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।

মামলার তদন্তে অনুযায়ী, ঘটনার সাথে একুশ জন জড়িত ছিলো বলে তথ্য পেয়েছিল পুলিশ। জঙ্গিরা বাংলাদেশের আরও কয়েকটি জায়গায় রেকি করেছিল। কিন্তু তাদের হিসেবে দেখেছে, হলি আর্টিজানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছু ছিলোনা।

দ্বিতীয়ত এ জায়গা থেকে তাদের অন্যত্র সরে পড়ার সুবিধা ছিলো।
তৃতীয়ত , এখানে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি একসাথে পাওয়া যাবে।
এসকল কারনেই ঘটনার ২/৩ দিন আগে তারা হলি আর্টিজানকে হামলার জন্য চূড়ান্ত করে।

তবে এর পরবর্তী কাল থেকে আমাদের দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা গুলো আরো বেশি তৎপর হয় । যাতে করে হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলার ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জন্যে জঙ্গিরা আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না। যা কিনা দেশ ও জাতির মঙ্গল জনক।

মো মিনহাজুল ইসলাম
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *