হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতিতে অম্লান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতিতে অম্লান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সানজিদ আরা সরকার বিথী
ঢাবি প্রতিনিধি


তিনি যাদুকর হুমায়ুন আহমেদ ;ছাত্র ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফজলুল হক হলে সিট বরাদ্দ দেয়া হলেও মুহসিন হলে স্থাপিত নতুন লিফট তাকে আকর্ষিত করায় থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলের ৫৬৪ নং কক্ষে।

তার হল জীবনের প্রিয় বন্ধু ছিলেন আহমদ ছফা, আনিস সাবেত।ছাত্রজীবন থেকেই তিন বন্ধু একটি বুদ্ধিভিত্তিক সাহিত্যসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করতেন। তারা চিন্তা করতেন, এদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক নতুন জগৎ নির্মাণ করবেন। অত্যন্ত মজার ব্যাপার ছিল তিনজন বন্ধুর অন্য একটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া, তাঁরা একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তাঁরা কখনোই বিয়ে করবেন না। অর্থাৎ চিরকুমার থাকবেন। কিন্তু পরবর্তীতে একমাত্র আহমদ ছফা ব্যতিত কেউই সে প্রতিজ্ঞায় স্থির থাকতে পারেন নি। এবিষয়ে হুমায়ুন আহমেদের পরবর্তী কাহিনী সম্পর্কে সকলেই অবগত আছি।

হুমায়ুন আহমদ হাত দেখা এবং যাদু জানতেন। হলে থাকাকালীন প্রায় সময় কামরাঙ্গীর চরে টিউশন এবং একটি স্কুলে ক্লাস নেওয়ার জন্য যেতে হতো তাঁকে। সেখানকার চায়ের দোকানে কিংবা রাস্তার মোড়ে তিনি যাদু দেখানো শুরু করতেন। অসংখ্য লোক তার যাদু দেখার জন্য জমায়েত হত। মূলত তিনি মানুষকে মজা দিয়ে নিজে মজা পেতেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর অসংখ্য গল্প-উপন্যাস সৃষ্টির মাধ্যমে এই ম্যাজিক দেখিয়ে গিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোই ছিল পাকবাহিনীর প্রথম টার্গেট। রমজান মাসে কিছু বন্ধু রোজা না থাকায় দুপুরে খিচুড়ি রান্না করছিলেন হুমায়ুন আহমেদ;তিনি খুব ভালো রান্না করতেন।

আকষ্মিকভাবে হল গেইটে পাকবাহিনীর একটি গাড়িবহর উপস্থিত হয়েছে। সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। হুমায়ুন আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে অনেক ভীতু থাকায় তাঁর বুক থরথর করে কাঁপছে।কক্ষে প্রবেশ করে সন্দেহজনকভাবে হুমায়ুন আহমেদ সহ অসংখ্য ছাত্রকে ধরে নিয়ে গেল। সেইসময় পাকবাহিনীর নিজস্ব তৈরি করা সেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্দেহজনক ছাত্র-শিক্ষককে ধরে বন্দি করে অকাথ্য জুলুম নির্যাতন করত। হুমায়ুনকে একটি বদ্ধ কক্ষে বন্দি করে রাখা হল। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তিনি সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন।

তিনি তার উপন্যাস ‘মাতাল হাওয়ায়’ বইয়ের ৩২ নং পৃষ্ঠায় বলেছেন-

“মহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে রসায়ন বিভাগের অতি নিরীহ একজন ছাত্র বাস করত।এসএসসিএবং এইচএসসি তে তার রেজাল্ট ভালো ছিলো বলে তাকে একটি সিঙ্গেল সিটের রুম দেয়া হয়েছিল।

এই বেচারা এনএসএফ (আইয়ুব খানের ছাত্র সংগঠন) এর নেতাদের ভয়ে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকতো।একদিন কোনো কারণ ছাড়াই এনএসএফের নেতারা তার ঘরে ঢুকে রুম তছনছ করে দিলো।তোষক জ্বালিয়ে দিলো এবং বেচারার নিজের টাকায় কেনা অর্গানিক কেমেষ্ট্রির মরিসন এন্ড বয়েডের লেখা বিশাল বইটাও ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেললো।বই কুটিকুটি করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণে-বইটা সে অনেক দাম দিয়ে স্কলারশিপের টাকায় কিনেছে। তার একটাই বই। কেমিস্ট্রির অন্য বইগুলি সে লাইব্রেরী থেকে এনে পড়তো।নতুন করে আরেকটা তোষক কেনার টাকা তার ছিলোনা। খাটে পত্রিকার কাগজ বিছিয়ে ঘুমানো ছাড়া তার কোনো পথ রইল না।

গোবেচারা এই ছাত্রের নাম হুমায়ুন আহমেদ। তার ঘর তছনছ করার ঘটনা তদন্ত করতে এলেন হাউস টিউটর প্রফেসর এমরান(পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক)। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। ছাত্রদের প্রতি মমতার তার কোনো কমতি ছিলোনা।

স্যার আমাকে বললেন,কারা এই কাজ করেছে তাদের নাম বলো।কাগজে লিখে দাও।তদন্তে সত্যি প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তি হবে।হল থেকে বের করে দেওয়া হবে।আমি নাম কাগজে লিখে স্যারের কাছে দিলাম।

তিনি নামের তালিকা পড়ে ঝিম ধরে গেলেন এবং বললেন, পলিটিক্স ছেড়ে দাও।পলিটিক্স করো বলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।আমি বললাম, স্যার আমি পলিটিক্স করিনা।

এমরান স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, অাবার মিথ্যা কথা বলে বেয়াদপ ছেলে!সিট ক্যানসেল করে দেব।তুমি পলিটিকস করোনা,তারা খামাখা তোমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে,আমাকে তুমি কী ভাবো?আমি দুদু খাই?

স্যার নাম লেখা কাগজ আমার হাতে ফেরত দিয়ে চলে গেলেন।সন্ত্রাসের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আগেও মাথা নীচু করে থাকতেন।এখনো থাকেন।”

তিনি যখন ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন একদিন হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিচ্ছেন।হঠাৎ এক ছাত্র প্রশ্ন করলাে, স্যার, আপনি নাকি গরুর কথাও বুঝতে পারেন ?

হুমায়ুন আহমেদের ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটি পড়ে হয়তাে এমন ধারণা হয়েছিলাে ছাত্রটির।

ক্লাসের মাঝখানে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় চলে আসায় হুমায়ুন আহমেদ বিরক্ত হয়ে বললেন, হ্যা, পারি। নইলে তােমাদের ক্লাস নিচ্ছি কীভাবে ?

এমন অসংখ্য স্মৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্দী হয়ে আছে গল্পের যাদুকর হুমায়ুন আহমেদে স্মৃতির খাতায় ;টিএসসিতে এখনো হুমায়ুনের আগমন ঘটে হিমু,রুপা, মিসির আলি কিংবা শুভ্রর বেশে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *