গোলাম মোস্তফা
তখনো ফজরের আজান হয়নি। মুয়াজ্জিন সাহরি খাবার জন্য মসজিদের মাইকে সবাইকে আহ্বান করছেন। চারিদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। তৌহিদুল সাহরি গুছিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছে। তার সব কাজই বেশ গোছালো। টেবিলের উপরের বইগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কত সুন্দর করে গোছানো। হয়ত সে সাহরি খেতেই যাচ্ছিল। কিন্তু তার ভাগ্যে সেই খাবার জুটলো না।
কেনোনা খাবার খাওয়ার আগেই ঘাতকের ছুরির আঘাতে তার প্রাণ প্রদীপটি নিভে গেছে। আর টেবিলের উপরের থালায় রাখা সাহরির সাদা সাদা ভাতগুলো তৌহিদুলের অপেক্ষায় আছে! কিন্তু সে অপেক্ষার কোনো শেষ নেই!
তৌহিদুল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়তেন ফিনান্স বিভাগে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি বিবিএ, এমবিএ শেষ করে পরিবারের হাল ধরতেন। হয়ত চাকরির জোগাড়ের চেষ্টা করতেন। অথবা কিছু একটা করতেন।
কিন্তু তার আশা ভরসা সব শেষ। সেই সাথে খালি হয়ে গেলো তার গর্ভধারিণী আত্মত্যাগী মায়ের কোল। সব মায়েরাই সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ করেন। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। কত দিন চোখের পানি ফেলেন। সে কথা মা ছাড়া কেউ জানে না। তৌহিদুলের জন্যও হয়ত তার মা কত আত্মত্যাগ করেছেন! ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ভেবে কত স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু সেসব স্বপ্ন ঘাতকের ছুরির আঘাতে এক নিমেষেই শেষ হয়ে গেছে।
এদেশে প্রায়ই তৌহিদুলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হত্যার শিকার হয়। মায়ের কোল খালি হয়। হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন হয়। মিছিল মিটিং হয়। তদন্ত কমিটি হয়। মিডিয়ায় খবর হয়। কিন্তু যা হয় না তা হল বিচার। আর বিচার না হলেই কেউ বলবে সরকারের দোষ। কেউ বলবে বিরোধী দলীয় ষড়যন্ত্র। কেউ কেউ নিহত পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয় খোজার চেষ্টা করবে। নিহত ব্যক্তির দোষ খোঁজার চেষ্টা করবে। কিন্তু এইসবের মূলে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিতেও হত্যাকে জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে বিভিন্ন ধর্মে বলা হয়েছে৷ ইসলামে বলা হয়েছে একজন মানুষ হত্যা মানেই পুরো মানবজাতিকে হত্যার সমান। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে আছে, হত্যা মহাপাপ। অথচ এই মহাপাপটিই ঘটছে অহরহ। এইসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, অন্য মতের প্রতি অশ্রদ্ধা, স্বার্থপরতা,লোভ-লালসা,ভোগ, মানসিক সংকীর্ণতা এগুলো হল মৌলিক কারণ। আর অন্য কারণগুলোতো আছেই।
এই দেশকে যিনি জন্ম দিয়েছিলেন, এই দেশটির নাম যিনি ‘বাংলাদেশ’ রেখেছিলেন সেই মহান নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫সালের ১৫ অগাস্ট রাতে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পরিবারের ছোট্ট শিশু রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়। কতটা নির্মম! কতটা নির্দয়! বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কিন্তু সাথে সাথেই বিচার হয়নি। চার দশক পরে এসে বিচার হওয়া শুরু হয়েছে। তো সেই ৭৫ থেকেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী ভিত নিয়ে গড়ে উঠেছে এবং এখনো চলছে এই সংস্কৃতির যাত্রা। তাইতো আমরা তৌহিদুলের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হত্যা হলেও বিচার পাই না। যেমনটি লিপু হত্যার বিচারও হয়নি।
২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর মোতালেব হোসেন লিপুকে হত্যা করা হয়েছিল। লিপু ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের(রাবি) শিক্ষার্থী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়তেন।
লিপুর বাবা একজন দিনমজুর। বর্তমান সরকারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তো লিপু রাবির নবাব আব্দুল লতিফ আবাসিক হলে থাকতেন। গভীর রাতে তাকে হত্যা করে লতিফ হলের ড্রেনের নোংরা পানিতে উলঙ্গ অবস্থায় ঘাতকেরা ফেলে রেখে যায়।
এরপর সহপাঠীরাসহ রাবি উত্তাল হয়ে ওঠে বিচারের দাবিতে। এর মধ্যে হলের সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব। তবে প্রথাগতভাবে যা যা করা দরকার সবকিছুই হয়। মামলা হয়। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে মামলা হাত বদল হতে থাকে। কিন্তু বিচার হয়না। একসময় লিপুর মা দাবী করেছিলেন তার ছেলের জিনিসপত্রগুলো ফেরত দিতে। কিন্তু যখনই এগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে চাওয়া হয়, তখনই বলা হয় তদন্তের স্বার্থে এগুলো দেয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কোল খালি হওয়া মায়ের ধৈর্যের বাধ মানে না। লিপুর কবরের পাশে বসে বসে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়।
লাশের পরিসংখ্যান বাড়ে। বাবার কাঁধে ছেলের লাশের কফিন। লাশ নিয়ে রাজনীতিও চলে। কিন্তু মায়ের শূন্য কোলে সন্তান ফিরে আসেনা। মা শুধু অপেক্ষায় থাকেন। কখন আসবে খোকা! কখন ছুটি পাবে। খোকার ছুটি হয়না। খোকা যে তার চির জনমের মতো ছুটি নিয়ে চলে গেছে। সে আর কোনোদিন ফিরবে না। মায়ের উঠোনে আর হাঁটবে না। মনে প্রশ্ন জাগে, ক্রমাগতভাবে মায়ের কোল খালি হওয়ার এই ধারাবিক ইতিহাস কি বন্ধ হবে না?
লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন সোসাইটি (বিইপিএস)।