শিক্ষাখাতের ক্ষতি পোষাবে কিভাবে ?

 

 

আবদুল্লাহ আল মামুন:মার্চের ১৭ তারিখ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আজ প্রায় ১৪ মাস মহামারীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থমকে গেছে।

দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো আপন মহিমায় ফিরতে শুরু করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ফিরতে পারেনি চেনা রূপে। প্রতিষ্ঠানগুলো নির্জীব হয়ে আছে। যেখানে শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে কল্লোলিত হতো সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূতুড়ে অবস্থা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়না, শিক্ষার্থীদের আন মনে তৈরী হয়না কোলাহল।

মহামারীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেও সরকার মহামারীর মধ্যেও প্রথম থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহন করে।শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য অনলাইন ও দূর শিক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। তবে সরকারে এই উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এটিকে নিয়ম রক্ষার উদ্যোগই বলা যেতে পারে।

কেননা দেশের সর্বত্র শিক্ষার্থীদের কাছে মোবাইল ফোন নেই, দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক সর্বত্র শক্তিশালী নয়। এর পাশাপাশি সব শিক্ষার্থীদের বাসাবাড়িতে সবার টিভি, রেডিও সেট নেই।  বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন সমস্যার সমাধান করলেও কলেজ, স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সেই সুবিধা পায়নি, টিভিতে ক্লাশ করালেও যাদের বাসায় টিভি নেই তাদের সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি।

একই সাথে মোবাইল নেটওয়ার্কের উন্নতিও সরকার ঘটাতে পারেনি। যার কারণে এটিকে নিয়ম রক্ষার উদ্যোগ বলা যেতে পারে। আর এর ফলাফলও যে খুব ভালো না সেটা একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা হতে দেখা যায়। একটি বেসরকারি গবেষণায় দেখা যায় দূর শিক্ষণ শিক্ষাকার্যক্রমে দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের ৬৯.৫০ অংশ নিতে পারেনি (সূত্র বিবিসি বাংলা, ২১ জানুয়ারি ২০২১ইং)।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূর শিক্ষণ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারলেও সবাই পরবর্তী ক্লাশে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণী কক্ষের পাঠদানের বড় একটা ঘাটতি নিয়ে পরের ক্লাশে উঠে যাচ্ছে। এই ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী ক্লাশগুলোতে উঠার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে শিক্ষার্থী, শিক্ষক তথা পুরা জাতিকে মূল্য দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের যেমন ক্লাশের পড়া বুঝতে অসুবিধা হবে তেমনি শিক্ষকদেরকে শিক্ষার্থীদের বুঝাতে অনেক বেগ পোহাতে হবে। সময় স্বল্পতা ও নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করার তাগিদে শিক্ষকদের পক্ষে পূর্ববর্তী পড়াগুলো পড়ানো সম্ভব হবেনা।

ফলে ক্লাশের পড়ায় একটা ঘাটতি নিয়েই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন শেষ করবে। এটা একজন শিক্ষার্থীর জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি দেশের জন্যেও ক্ষতিকর। এখানে অবশ্য এসাইনমেন্টের কথা আসতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চলমান রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের এসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। এসাইমেন্টের চিত্র খুব একটা ভালো নয়। ফেইসবুক গ্রুপগুলোতে এই এসাইনমেন্টগুলো পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের দেখা গেছে বই দেখে এই এসাইনমেন্ট জমা দিতে, এক একজন আরেকজনের কাছ থেকে কপি করতে।

প্রকৃতপক্ষে যেহেতু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা হয়নি এবং অনলাইন কিংবা টেলিভিশন ক্লাশের সুযোগ খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই পেয়েছে সেহেতু ফেইসবুক গ্রুপ, বই দেখে লেখা, আরেকজনের কাছ থেকে কপি করে সেটা জমা দেওয়াই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন সড়ক দুর্ঘটনায় শাবিপ্রবি ছাত্রের মৃত্যু

মিত ক্লাশ পরীক্ষা হলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পরীক্ষা আটকে আছে। যার জন্য শিক্ষার্থীরা চাকরি পরীক্ষা দিতে পারছেনা, পারছেনা পরবর্তী বর্ষে উত্তীর্ণ হতে। এতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মজীবন হতে পিছিয়ে পড়ছে, পারিবারিক চাপ বাড়ছে, বাড়ছে হতাশা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাশ পরীক্ষা ঠিক করে হলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরীক্ষা না হওয়ার কারণে শিক্ষাক্ষাতে তৈরী হচ্ছে বৈষম্য।
এই সমস্যাগুলোর পাশাপাশি আরও কিছু সমস্যা তৈরী হচ্ছে। দীর্ঘদিন পড়াশোনার পরিবেশ থেকে বাহিরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে, বাল্যবিবাহ বেড়ে যাচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা স্কুল হতে ঝড়ে পড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অনিয়মিত ক্লাশ, নগরে ও গ্রামের সুযোগ সুবিধার কারণে শিক্ষা বৈষ্যম তৈরি হচ্ছে প্রকট ভাবে।

আরও পড়ুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন!

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রায় ১৪ মাস। মে মাসের ২৩ তারিখ স্কুল,কলেজ এবং ২৪ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা থাকলেও সেটা অনিশ্চিত। দেশের প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা নিশ্চিত হওয়া ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা প্রায় অনিশ্চিত। শিক্ষাখাতে তৈরী হওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে হবে সেটা এখনো আমাদের অজানা।

সম্প্রতি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো অনলাইনে নেওয়ার কথাবার্তা শোনা গেলেও সেটা বাস্তবায়ন হবে কিনা, আর বাস্তবায়ন হলেও শিক্ষার্থীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।  একই সাথে শিক্ষাখাতে অন্য যে সমস্যাগুলো ইতোমধ্যে তৈরী হয়েছে এবং সামনে তৈরী হবে সেগুলোর সমাধান কী হবে এবং সেগুলো কীভাবে শিক্ষাখাতের সমস্যাগুলো নিরসন করতে পারে সরকারকে সেগুলো দেখাতে হবে, না হলে শুধু শিক্ষার্থদের না পুরা জাতিকেই এর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে হবে।

লেখা – আবদুল্লাহ আল মামুন
পরিসংখ্যান বিভাগ
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Scroll to Top