একজন জীবনানন্দ

একজন জীবনানন্দ

সাহিত্য টুডেঃ-

সাল ১৮৯৯। বিংশ শতাব্দীর তীক্ষ্ণ সব বিস্ময়ের সাক্ষী হতে নক্ষত্রের মত প্রকট হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রহেলিকাময় মানুষ শ্রী জীবনানন্দ দাশ।ছেলেটির নাম যখন জীবনানন্দ রাখা হলো,তখন কে জানতো এই লোকটির জীবনেই আনন্দের ছিঁটেফোঁটা ভাগও জুটবেনা? এ যেন কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন!

.
বরিশালের নদী, জোনাকি ছেড়ে তাঁকে পা রাখতে হয়েছে আদিম সাপের মত ছড়িয়ে থাকা কলকাতার ট্রামলাইনের ওপর।পৃথিবীর দিকে তাকিয়েছেন বিপন্ন বিস্ময়ে।বলেছেন সন্ধ্যায় সব নদী ঘরে ফিরলে থাকে অন্ধকার এবং মুখোমুখি বসবার নাটোরের এক নারী।জানিয়ে দিয়েছেন জ্যোৎস্নায় ঘাই হরিণীর ডাকে ছুটে আসা, শিকারীর গুলিতে নিহত হরিণের মতো আমরা সবাই।সস্তা বোর্ডিংয়ে উপার্জনহীনতায় দিনের পর দিন কুঁচো চিংড়ি খেয়ে থেকেছেন।তবুও পশ্চিমের আকাশে দেখেছেন সোনার সিংহ।পিঁপড়ার মত গুটি গুটি অক্ষরে হাজার হাজার পৃষ্ঠা ভরেছেন কবিতা,গল্প, উপন্যাস আর ডায়েরি লিখে।সেগুলোর সামান্য শুধুই এনেছেন জাদুকরের রুমালের মত মানুষের সামনে বাকিটা গোপনে তালাবদ্ধ করে রেখেছেন কালো ট্রাংকে।

[কর্মজীবন]

অধ্যাপনার কাজে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা ও সমাপ্তি। এমএ পাসের পর কলকাতায় কলেজের বোর্ডিংয়ে থাকার প্রয়োজন হলে তিনি আইন পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে টিউটর হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯২৮-এ সরস্বতী পূজা নিয়ে গোলযোগ শুরু হলে অন্যান্য কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে তাঁকেও ছাঁটাই করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। জীবনের শেষভাগে কিছুদিনের জন্য কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা স্বরাজ-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদনায় নিযুক্ত ছিলেন।

অধ্যাপনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যার মধ্যে আছে সিটি কলেজ কলকাতা (১৯২২-১৯২৮), বাগেরহাট কলেজ, খুলনা (১৯২৯); রামযশ কলেজ,দিল্লি(১৯৩০-১৯৩১), ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল (১৯৩৫-১৯৪৮), খড়গপুর কলেজ (১৯৫১-১৯৫২), বড়িশা কলেজ (অধুনা ‘বিবেকানন্দ কলেজ’, কলকাতা) (১৯৫৩) এবং হাওড়া গার্লস কলেজ, কলকাতা (১৯৫৩-১৯৫৪) তাঁর কর্মজীবন আদৌ মসৃণ ছিল না। চাকুরী তথা সুস্থির জীবিকার অভাব তাঁকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে।

একটি চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্ত্রী লাবণ্য দাশ স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবিকার অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর সময় তিনি হাওড়া গার্লস কলেজ কর্মরত ছিলেন। দুই দফা দীর্ঘ বেকার জীবনে তিনি ইন্সুরেন্স কোম্পানীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন এবং প্রধানত গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। এছাড়া ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসঙ্গী।

[প্রেম ও দাম্পত্য ]

ঝড়া পালক তাঁর প্রথম গ্রন্থ।এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ এর রহস্যময় উৎসর্গপত্র।উৎসর্গ পৃষ্ঠায় লিখা ছিলো “কল্যাণীয়াসুকে”। এই কল্যাণীয়াসু ছিলেন তাঁর কাকাতো বোন শোভনা দাশ ওরফে বেবী।বেবীর সাথে তার ক্ষণকালের সুতীব্র প্রেম ছিলো।যা লাবণ্যের সাথে বিয়ের পরও তাকে পুড়িয়েছে!প্রেমহীন আর অবজ্ঞার জীবনে শোভনা ই জীবনানন্দকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলো।এই বেবীর সাথে জীবনানন্দ দাশের সারাজীবন চলে এক আশ্চর্য প্রাণের খেলা!জীবনানন্দের ডায়েরিতে বেবীকে নিয়ে অজস্র লিখার সন্ধান পাওয়া যায়।মজার ব্যাপার হচ্ছে হচ্ছে শোভনা ওরফে বেবীকে তিনি ডায়েরি তে ইংরেজি ‘Y’ অক্ষরে লিখেছেন।

পরবর্তীতে পারিবারিকভাবে জীবনানন্দকে একবার দেখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে লাবণ্যপ্রভা। সাহিত্যের ছায়া থেকে একশ হাত দূরে থেকেও সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এই লাবণ্য। সেও কিছুকাল পরে টের পায় তার স্বাধীনতা হারিয়ে যাচ্ছে। মুক্তির জন্য ছটফট করতে থাকে। দুর্বিষহ হয়ে উঠে দুজনের জীবন। প্রেম সত্যি একসময় মুছে যায়। লাবণ্য একবার বলে বসল,’জীবনান্দ তো বাংলা সাহিত্য কে অনেক কিছু দিয়ে গেল, আমাকে কি দিয়ে গেল?

[নন্দনতত্ত্ব ]

প্রখ্যাত লেখক আনিসুজ্জামান এর জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটি ব্যাক্তিগত পর্যালোচনা পড়েছিলাম।উনি লিখেছিলেন উনার এক ভারতীয় বন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,তিনি পরেরবার যখন আসবেন তখন তাদের জন্য কি আনবেন?
জামাকাপড় নয়,খাদ্যদ্রব্য নয় তারা চেয়েছিলেন জীবনান্দের “রূপসী বাংলার” একটি কপি!

শহীদ জননী জাহনারা ইমামের ছেলে শহীদ রুমিকে সবাই চিনে।তার মৃত্যুকালেও তার হাতে একটি বই পাওয়া যায়।বইটি ছিল জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা!

[শেষযাত্রা]

সারাটা জীবন কেঁটেছে মানুষের অবহেলা,বিদ্রুপ আর ব্যক্তি আক্রমণের স্বীকার হয়ে।জীবনানন্দের লেখা কেউ বুঝতো না তাই সবাই তাকে পাগল,জোর করা ভাষা চাপানো,অশ্লীল লেখক আরো অনেক ভাবে অপদস্ত আর হেনস্থ করেছেন।তবুও থেমে যাননি জীবনানন্দ। তাঁর লেখার উপর তার বিশ্বাস ছিল অগাধ! সংগ্রাম, গ্লানিতে অসহায় জীবনানন্দ ডায়েরিতে লিখেছিলেন,

“কলকাতার ফুটপাত থেকে ফুটপাতে- ফুটপাত থেকে ফুটপাতে-
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি।”

ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়ার মতো সেই দুর্ঘটনা এর আগে কখনো হয়নি এমনকি তার পরেও নয়। রাত ১১টা ৩৫ মিনিটে ডাক্তার জীবনানন্দকে মৃত ঘোষণা করলে সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেন, ‘একটি জাহাজ ছেড়ে গেল…।’

আচ্ছা,জীবনানন্দ কি আত্মহত্যা করেছিল?
জাহাজ টা কি হুট করেই ছেড়ে গেল? নাকি অনেক প্লান করে, অনেক অসাহয়ত্ব, গ্লানি নিয়ে?

শূন্যে অবশ্য ভেসে রইলো অমীমাংসিত সেই জিজ্ঞাসা,জীবনানন্দের মৃত্যু তাহলে কি——
দুর্ঘটনা?
আত্মহত্যা?
নাকি হত্যাকান্ড? যার পেছনে রয়েছে অনেকের অদৃশ্য হাত?

সারাজীবন যে লোকটা মনোমুগ্ধকর রহস্যের মত লেখা লিখেছেন,আশ্চর্য মৃত্যুতেও তিনি এক রহস্য রেখে গেলেন!💔

সাহিত্যকর্ম ❤

[জীবদ্দশায় প্রকাশিত]
ঝড়া পালক (১৯২৭), ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২) , মহাপৃথিবী (১৯৪৪),সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), বনলতা সেন (১৯৫২,সিগ্নেট প্রেস সংস্করণ) , জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪)

[মৃত্যুর পরে প্রকাশিত]
রূপসী বাংলা(১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১), সুদর্শনা (১৯৭৪),জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪), মনবিহঙ্গম (১৯৭৯),
জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ (১৯৯৩), প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র(১৯৯৪)

[প্রবন্ধ]
কবিতার কথা (১৯৫৬), সমালোচনা সমগ্র (১৯৮৩)

[ছোটগল্প]
জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২),জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)

[উপন্যাস]
মাল্যবন (১৯৭৩), সুতীর্থ (১৯৭৭)

[চিঠিপত্র ]
জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলি (১৯৮৬]

জীবনানন্দের কবিতা দুরূহ নয়,দুর্বোধ্য। আমরা যখন জীবনানন্দের কবিতা পড়ি তখন একবারও অভিধানের শরণাপন্ন হতে হয় না,কিন্তু পড়ার পর মনে হয় কিছুই বোঝা গেলো না।তবুও তাঁর কবিতা আমাদের নেশার মত তীব্রবেগে টানে।তাঁর কবিতায় ভাব ও শব্দের এক অবিচ্ছিন্ন মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছেন।যা বুঝতে আমাদের দিনের পর দিন লেগে যায়।জীবনানন্দের কবিতা পদার্থ বিজ্ঞানের কোয়ান্টাম তত্ত্বের মত।যদি কেউ বলেন জীবনানন্দের কবিতা বুঝেছি,তাহলে তিনি কবিতার কিছুই জানেন না।আসলে জীবনানন্দের কবিতা কেউ বুঝেন না,বোঝার ভান করেন মাত্র!

জীবনানন্দ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি।তাঁকে বাংলাভাষার “চিত্ররুপময়”, “শুদ্ধতম কবি”, “নির্জনতম কবি”, “রূপসী বাংলার কবি” বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত।

তথ্যসূত্রঃ একজন কমলালেবু (শাহাদুজ্জামান), জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ (সৈয়দ আবুল হাসনাত, বিভিন্ন পত্রিকাও ইন্টারনেট!

© রুদ্র মানিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *