করোনা প্রার্দুভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন


করোনা প্রার্দুভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন: বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীদের মানবীয় গুণাবলীর উপস্থিতি শীষর্ক একটি গবেষণার প্রাথমিক রিপোর্ট।


আবু জাফর আহমেদ মুকুল, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম


ইউরোপ বা আমেরিকায় স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশগ্রহন করতে হয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে Volunteer work (সেচ্ছাসেবা) করার জন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং কাজটিকে কোর্স ক্রেডিট হিসেবে গণনা করা হয়।

সংবাদ পত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা প্রার্দুভাবে আইন শৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ইংল্যান্ডে প্রায় ২৬,০০০ ও ইতালিতে প্রায় ২৩,০০০ সাধারন প্রশিক্ষিত লোক সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে এবং এর একটা বড় অংশই শিক্ষার্থী। করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য চার ধরনের স্বেচ্ছাসেবক (স্বাস্থ্যক্ষেত্র, যোগাযোগ, ঘরে বসে উৎপাদন এবং জরুরি সেবা) চেয়ে গণমাধ্যম এবং সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে ভারত সরকার।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই আবার আলাদা কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। যেমন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। শুধু মাত্র চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই এ কাজে যোগ দিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যোগাযোগ ক্ষেত্রেও নানা ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে। বাড়িতে বসেই সরকারের বিভিন্ন হেল্পলাইন অপারেট করা করা সম্ভব। তৃতীয়ত, বাড়িতে বসে উৎপাদন ক্ষেত্রেও কাজ করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে কোনও সংস্থা স্যানিটাইজার এবং মাস্ক উৎপাদন করে সরকারকে দিতে পারে। আর, চতুর্থ ক্ষেত্রটি সরাসরি প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য,যেমনঃ পুলিশ, সরকারি প্রশাসকদের সহকারি হিসেবে কাজ করার।

গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই স্বেচ্ছাসেবীদের তালিকায় ভারতে নাম লিখিয়েছেন প্রায় ৩৪ হাজার জন আর প্রায় ১৫০০টি সংস্থা তাদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। জাপানে স্কুলে প্রত্যেকটি বাচ্চার বৈশিষ্ট্য বিষয়ে শিক্ষকগণ পর্যবেক্ষন রাখেন এবং মানবতাবোধ তৈরি করেন।

বাস্তবতা হলো: বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে ভারতশ্বেরী হোমস্সহ মাত্র কয়েকটি স্কুল স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

কিন্তু সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ভারতশ্বেরী হোমস্ এর মতো স্বেচ্ছাসেবীর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো, তাহলে দেশে স্বেচ্ছাসেবা কাজ করার মতো লোকের অভাব হতো না। সুতরাং শিশুকালে বীজ বপন করা জরুরি। পরিবার থেকে কলেজ পর্যন্ত মানবিক কাজের প্রতি ধারাবাহিকতায় থাকলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা স্বেচ্ছাসেবী কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

আমাদের দেশে এখনও সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে এই স্বেচ্ছাসেবকদের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। এখনই তাঁরা কাজ শুরু করে দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শিখে যাবেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্বেচ্ছামূলক কাজটি এখন তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে কাজটি করে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তবে এটি যদি শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন থাকতো আমাদের দেশেও প্রায় ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী আইন শৃঙ্খলার বাহিনীসহ সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করার একটি প্লাট ফর্ম তৈরি হতো।

এ বিষয়ে আমরা গত মার্চ ১০ থেকে ৩১, ২০২০ইং পর্যন্ত বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন যারা বিভিন্ন লেভেলে বা সেমিস্টারে অধ্যয়নরত সিজিপিএ (৩.৫ নীচে) পাওয়া ৮০ জন, সিজিপিএ (৩.৫- ৩.৭৫) পাওয়া ৫৫ জন এবং সিজিপিএ (৩.৭৬- ৪.০০) পাওয়া ১৫ জনসহ সর্বমোট ১৫০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাদের গবেষণার অংশ হিসেবে একটি জরিপ চালাই।

এরপর পারফরম্যান্স মূল্যায়নের জন্য মানবীয় গুণাবলীর সম্পর্কীত বিভিন্ন প্রশ্ন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী দ্বারা টেলিফোন ইন্টারভিউ ও অনলাইনে মাধ্যমে পূরন করানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সেমিস্টারের সিজিপি এর উপর ভিত্তি করে শ্রেনী বিন্যাস করা হয় যা নিম্নে প্রাথমিকভাবে তুলে ধরা হলঃ

১.বিশ্ববিদ্যালয়ে সিজিপিএ (৩.৫ নীচে) পাওয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা (৬৫ জন) বেশি মানবীয় গুণাবলী ধারণ করে যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৬২%। volunteer worker হিসেবে তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বেশি পছন্দ করেন।

২. সিজিপিএ (৩.৫- ৩.৭৫) পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে (৩৬ জন) মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৩৪%।

৩. সিজিপিএ (৩.৭৬- ৪.০০) পাওয়া শিক্ষার্থীরা (৪ জন) মানবীয় গুণাবলী ধারন করে যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৪% । তারা নিজেরে ক্যারিয়ারের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। বেশির ভাগ মনে করেন স্বেচ্ছামূলক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এটি তাদের দায়িত্ব নয় এবং রাষ্ট্র/কর্তৃপক্ষ এককভাবে বিষয়টিতে দায়বদ্ধ। স্বেচ্ছামূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণও খুবই কম এবং পরিবার থেকেও উৎসাহ কম পান তাঁরা। তবে ক্ষেত্র বিশেষে লক্ষ্য করা যায়, ১% মানবতা অনেক সময় ব্যক্তি বিশেষে ১০০% স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।

৪. বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মনে করেন, ক্লাসে ১% শিক্ষক দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন । সারা বছর ৩% শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করে থাকেন এবং বেশির ভাগ শিক্ষকগণ সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা শ্রমে যে সকল শিক্ষার্থী নিয়োজিত তাদেরকে নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখেন এবং একাডেমিক কাজে সহায়তা কম করেন । শিক্ষকদের মধ্যে মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব/পেশাগত হিংসা থাকায় অনেক জুনিয়র শিক্ষক সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে স্বেচ্ছামূলক কাজ করতে আগ্রহী হন না। অথচ, বিপরীতক্রমে জাতীয় ক্রান্তি লগ্নে/ করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময়ে প্রায় ৬৭% শিক্ষক শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রশংসা করেন।

৫. বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি সচেতন কিন্তু শারীরিক কাজ করতে আগ্রহ কম । সারা বছর ৭% শিক্ষার্থীরা সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করে এবং বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা শ্রম নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন এবং একাডেমিক পড়ায় মুখস্থ করতে বেশি পছন্দ করেন । জাতীয় ক্রান্তি লগ্নে/ করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময়ে প্রায় ১৫% শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছামূলক কাজ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ৬% শিক্ষার্থীকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে লক্ষ্য করা যায়।

উপরের পাই চার্টে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে মানবতার শতকরা হার বর্ননা করা হয়েছে তা ব্যক্তি বিশেষে তারতম্যও হতে পারে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি ও বৃহত্তর ক্ষেত্র বিবেচনায় উপরের উল্লেখিত ফলাফলের বাস্তবতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করে।

মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষা নীতি বিষয়ে বলেন,”শিক্ষার বিষয়টা শুধু পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। শেখার মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা, যেকোনো সমস্যাকে মোকাবিলা করা ও গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন, মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম—সবকিছুই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন,” আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি যে, এখনকার জিপিএ-৫ নির্ভর প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখার যে প্রচলন রয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা যে বিদ্যার্থী, তা থেকে বের হয়ে কেবল পরীক্ষার্থী হয়ে গেছে। পড়াশোনার উদ্দেশ্য যে কেবল সার্টিফিকেট অর্জন নয়, প্রকৃত বিদ্যা অর্জন, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে গেছি।” আমাদের গবেষণায় সাথে শিক্ষা নীতি নির্ধারকের মতামতের সাথে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়।

তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সময় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার্থীরা সকালে থিউরি ক্লাস পরে বিকালে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীরা এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত থাকে।

তাছাড়া, শিক্ষার্থীরা একাডেমিক বিভিন্ন কোর্সের পরীক্ষার চাপের পাশাপাশি ব্যাপক হারে বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকুরির কেন্দ্রিক প্রস্তুতিতে বেশি মনযোগী। শিক্ষার্থীদের ১ম প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জিপিএ পাবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা হ্রাস করে মানবতা ও দেশপ্রেম উপলব্ধি করা দরকার।

আশা করছি, এরই ধারাবাহিকতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মুখস্থ বিদ্যার উপর বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্রায়োগিক ও মানবিক বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দিবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এ বিষয়ে আন্তরিক ও শিক্ষার্থীদের উদ্ভুদ্ধ করলে বাংলাদেশের যে কোন ক্রান্তিকালে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাই অন্যান্য দেশের মতো প্রশিক্ষিত ও সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের তরুন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের নেতৃত্বের বাহক।আর, তাই এই শিক্ষার্থীরা মানবিক হলে দেশটার চিত্রই বদলে যাবে।


লেখকবৃন্দ : শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর শিক্ষক ।

সংবাদটি শেয়ার করুন
fb-share-icon
Tweet

এই বিভাগের আরও সংবাদ

Leave a Comment