এমন ঈদ দেখেনি কেউ আগে

মো. মজনুর রশিদ


ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ। মুসলিম বিশ্বে ঈদের নতুন চাঁদ দেখার সাথে সাথেই চারদিকে ছড়িয়ে পরে ঈদের অনাবিল আনন্দ। ঈদ মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।

নতুন পোশাক পরিধান করা, পাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা, ভালো ও উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা, পারস্পারিক ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা, ঈদগাহে বড় জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করা, ঈদগাহ মাঠের পাশে শিশুদের আনন্দ উৎসব, বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, ধনী ও স্বল্প আয়ের মানুষের মনে খুশির হাসির নামই হলো বাংলার ঈদ আনন্দ।

তবে খুশির ঈদের আনন্দ বেশি অনুভুত হয় শিশু, কিশোর ও যুবকদের মাঝে। বয়স্করা সেসব দিন অতীতে ফেলে এসেছে। কর্ম ব্যস্ত ও বাসা-বাড়ির অন্য সদস্যদের আনন্দ উৎযাপনের নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় তাঁরা এবং পরিবারে অর্থের যোগান দেয়া ও না দেয়ার উপলক্ষ হয়ে থাকে তারা। ফলে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তির ঈদ আনন্দ শিশু কিশোরদের ঈদ আনন্দ থেকে একটু ভিন্ন ধাঁচের হয়ে থাকে। তবে ঈদের আনন্দ সবার মাঝেই কম বেশি থেকে থাকে। বাঙ্গালির ঘরের ঈদ বলে কথা! ঈদ মোবারক।

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা এই দুটি ঈদ মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের দিন। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর বিশেষ কড়াকড়ির মধ্যে উদযাপিত হতে যাচ্ছে এ বছরের (২০২০ সালের) ঈদ আনন্দ।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুশিয়ারি ও আইইডিসিআর এর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে এ বছরে ঈদের জামাত সীমিত পর্যায়ে করার আহবান জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সেই সাথে ঈদগাহে বা খোলা মাঠে বড় জমায়েত না করে মসজিদে ঈদের জামাত আদায় করার নির্দেশনা জারি করেছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। নিজ নিজ পাড়া বা মহল্লার মসজিদেই এবার ঈদের নামাজ পড়তে হবে সকলকে।

সেই সাথে ঈদ নামাজ শেষে পারস্পারিক কোলাকুলি ও হ্যান্ডসেক করা থেকেও বিরত থাকার আহ্বান রয়েছে। ফলে থাকছে না মুসলিম উম্মার চিরাচরিত ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ব্যবহার! সামাজিক না বরং শারীরিকভাবে দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যাবে।

সংগত কারণেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোভিড-১৯ এর কারণে ঈদের জামাতের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কোনো কোনো দেশে রয়েছে সীমিত পর্যায়ে ঈদের নামাজ পড়ার অনুমতি। আবার কোনো দেশে ঈদের দিনে কারফিউ জারি করা হয়েছে (সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ)। মোট কথা সারা বিশ্বে এ বছরের ঈদ আনন্দ উদযাপিত হচ্ছে ঘর বন্দি অবস্থায়। একই সময়ে যা বিশ্ব দেখেনি এমনটি আগে কখনো।

সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সকলকেই মেনে চলতে হবে সরকারের দেয়া কিছু বিধি নিষেধ। রাষ্ট্র তার জনগণের নিরাপত্তার জন্য কখনো কখনো এমন কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। যা জনগণকে স্বাচ্ছন্দে এসব নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়। এসব মেনে চলার মাধ্যমে নাগরিকের দায়িত্ব ও সুনাগরিকের পরিচয় বহন করে। এর মধ্যে রাষ্ট্র ও জনগনের সার্বিক মঙ্গল নিহিত থাকে।

কিন্তু সব সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো এক রকম না। এছাড়াও রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডির মধ্যে বিনোদন ব্যবস্থার যথেষ্ট ঘাটতি। এসব নিয়ম ভঙ্গের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে হাদিসেও উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো মহামারীর সময় মানুষ যেনো তাঁদের নিজ নিজ ঘর বা বাসা-বাড়িতে অবস্থান করে নিজেকে নিরাপদ রাখে।

কোভিড-১৯ এর কারণে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ অনেক ক্ষেত্রে জনগণ কম মান্য করে চলেছে। এর ফলে দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও বৃদ্ধি পেতে পারে। যে কারণে করোনা ভাইরাস সনাক্তের প্রায় ৭৫- ৮০ তম দিনে এসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে (তথ্য সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন)।

পায়ে হেঁটে গার্মেন্টস কর্মীদের ঢাকা গমন, ঢাকার রাস্তায় মানুষ ও ব্যক্তিগত পরিবহনের চাপ, ঈদের আগে মার্কেটে সাধারণ মানুষের উপচে পরা ভিড়, স্বাস্থ্য বিধি না মানার প্রবণতা, আবার ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে ঢাকা ফেরত গ্রামমুখী মানুষের গাদাগাদি করে ফেরি পরাপারের দৃশ্য (তথ্য সূত্র: বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া, মে ২০২০) বর্তমানে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে বলে অনেকে মনে করে। অপর দিকে ইউরোপ আমেরিকার তুলনায় করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে শিশু, কিশোর ও যুবকের মৃত্যুর হার বেশি (তথ্য সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিন এপ্রিল-মে ২০২০)।

“চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্যা টাইম অব কোভিড-১৯” শিরোনামে শিশু ও তরুণদের ওপর করোনা পরিস্থিতির প্রভাব জানতে ওয়াল্ড ভিশন জরিপ বলছে, উন্নয়নশীল দেশসমূহে ৭১ শতাংশ তরুণ নিঃসঙ্গতা অনুভব করে। ৯১ শতাংশের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, রাগ, শঙ্কাসহ নানা মানসিক চাপ (তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৯ এপ্রিল ২০২০)।

অপরদিকে ঈদের ক’দিন পূর্বে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নিয়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণি ঝড় ‘আম্পান’ (তথ্য সূত্র: আবহাওয় অধিদপ্তর, সময় সংবাদ, ২০ মে ২০২০)। স্বরণ কালের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সুপার সাইক্লোন ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ এর তান্ডবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির চিহ্ন রেখে গেছে। আবারও সুন্দরবন বুক চিতিয়ে ভয়াবহ ক্ষতির মুখ থেকে রক্ষা করল বাংলাদেশকে (তথ্য সূত্র: সময় সংবাদ, ২১ এপ্রিল ২০২০)।

তবুও এই ক্ষতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য জীবন ধারণ হয়ে পড়েছে আরো কঠিন। কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাসের এমন মহামারীর কালে ‘আম্পান’ বাংলাদেশের জন্য ‘মরার ওপর খরার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন মানুষের অবস্থা হয়ে পরেছে দুর্বিষহ।

যদিও সরকার এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশংসনীয় সক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। সামাজিক বাস্তবতার এমন অবস্থায় মানব সমাজ তথা দেশবাসী পড়েছে নতুন অচেনা উভয় সংকটে। ঘরে থাকা বড় দায়, বাহির হলে মৃত্যুর ভয়! এরই মাঝে উদযাপিত হচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ আনন্দ। ঈদ মোবারক।

নানা প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগে ব্যহত হচ্ছে সরকারের গৃহীত টেকসই উন্নয়ন নীতি। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে চলতে কিছু আইন ও সামাজিক বিধি বিধান মান্য করার প্রবণতা জনসাধারণের মাঝে সৃষ্টি করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব হওয়া উচিৎ এবং সামাজিক আচার আচরণ মান্য করা এই দু’টি বিষয়কে বাস্তবিক চর্চার মধ্যে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কিছু দরকারি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যেতে পারে:

১. পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা সংযুক্ত রেখে স্ব শিক্ষা ও গুণগত শিক্ষার
হার ও মানের বৃদ্ধি ঘটানো।

২. কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করা।
৩. জনসাধারণের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৪. সামাজিকীকরণের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
করা।
৫. সব ক্ষেত্রে সামাজিক পরিবর্তেনের সাথে সাথে অপরাধ দমনে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।

৬. রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি বিধান; আচার আচরণ; প্রথা পদ্ধতি; ইতিহাস ঐতিহ্য; ন্যায়
অন্যায়; আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চার সঠিক প্রয়োগ করা।
৭. সামাজিক জীব হিসেবে কোনটি করা উচিৎ আর কোনটি করা উচিৎ না সে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
৮. সামগ্রিক উন্নয়নের নামে মানবিক বোধকে ধ্বংস না করে প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রেখে উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করা।
৯. গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী মুক্তি, মুক্ত চিন্তা, গবেষণা ও বৈশ্বিক জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রকে
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অবারিত করা।

এসব বিষয় ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে মানব সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন কমবে ঠিক তেমনি হ্রাস পাবে পৃথিবীর বুকে আঘাত হানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের হার। বিশ্ব মাতব্বরের দরবারে এমন একটি পৃথিবী গড়ে তোলার আহবান এসেছে প্রকৃতির নিকট থেকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ বিশ্ব শান্তির জন্য এক জোট হয়ে কাজ করেছিলো।

কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ব গড়তে সব ধরণের উগ্রতা, দাম্ভিকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, জোর জবরদস্তি, জুলুম, হুমকি, হিংসা, পরশ্রীকাতর, নির্ভরশীলতা, সামাজিক অসমতা ও অসম উন্নয়ন, পারস্পারিক অশ্রদ্ধা বোধ, নিগ্রহ ও পরাধীনতা প্রভৃতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ কল্যাণকর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। ভবিষতের এমন একটি বিশ্ব ও দেশে নিশ্চয় সব ধরণের উৎসব আয়োজন নিয়ে ঈদ ও অন্যান্য উৎসব আনন্দ উৎযাপন করতে পারবে বিশ্ব ও দেশবাসী।

অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মুক্ত ধারার এই বিশ্ব বর্তমানে অবরুদ্ধ কোভিড-১৯ এর প্রভাবে। এর প্রভাবে মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোজা ও ঈদুল ফিতরের আয়োজনে এসেছে ভিন্ন রূপ। সামাজিক সম্পর্কগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে ইথার তরঙ্গে, বার্তা আদান প্রদানের মধ্যে। সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশে, বন্ধু-বান্ধব ও আপন পরিজনদের সাথে। কিন্তু সব সময় সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রিয় মানুষগুলোকে কাছে পাবার তৃপ্ততার অনুভূতি পূরণ করতে পারে না।

আমাদের দেশে ঈদে আপনজনদের কাছে পাবার আনন্দ অনেক কিছুর আনন্দ প্রাপ্তির সমান। মায়ের সাথে সন্তানের চোখের দেখা ও কাছে পাবার টান কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করার না। পারিবারিক ও সামাজিক অন্যান্য সম্পর্কের জালগুলোর মধ্যে সম্পর্ক তেমনি। এ বছরে অনেকেই পরিবার পরিজন অথবা আপন জনদের ছাড়াই ঈদ আনন্দ সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। যদিও দীর্ঘ ছুটিতে অনেকেই নিজ বাড়িতে আপনজনদের সাথে রয়েছে।

আবার অনেকেই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে। যারা প্রবল ইচ্ছে থাকলেও গ্রামের বাড়িতে ঈদ আনন্দে সামিল হতে পারছে না। এই ঈদ যাত্রায় ছোট ছেলে মেয়ে ও ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে দূরের পথে যাত্রা করাও বিপদজনক। অপরদিকে একটু ভেবে দেখুন! ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী, ডিসি, এসপি, ইউএনও, প্রধানমন্ত্রীসহ বিশেষ বিশেষ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, জরুরী পরিসেবায় খুলে দেয়া মন্ত্রাণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারী, পুলিশ সদস্য, সেনাবাহিনী, জরুরী সেবাদান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মীরা, বিদেশের মাটিতে আটকিয়ে থাকা দেশের নাগরিক, পরিচ্ছন্ন কর্মী, কোভিড-১৯ এর ল্যাব পরীক্ষায় নিয়োজিত গবেষক, শিক্ষক ও কর্মীদের পরিবার পরিজন ছাড়া একাকী ঘরে বসে ঈদ উৎযাপন করবে। সেটা অনেক বেশি বেদানাদায়ক।

মনের মাঝে এমন ভাবনা কষ্টকর ও বিষাদময়। জনগণ ও দেশের প্রয়োজনে তাঁরা অনেক কিছুর সুখ আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছে এই ঈদ আনন্দে। সাধারণ জনগণের উচিৎ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা ও এসকল জন কল্যাণে নিবেদিত মানুষগুলোকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রদান করা। ঈদ, পূজা, বড় দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বিজু উৎসব এসব সুখ আনন্দের উৎসবসমূহ পূর্ণতা পায় আপনজনদের কাছে পাবার মাধ্যমে। বাঙ্গালির মাঝে আপনজনের মধ্যকার টান হাজার বছরের ঐতিহ্যের নিদর্শন।

আমাদের সমাজে আপনজনদের অনেক দিনের দূরে থাকার পরে প্রাণের কাছাকাছি আসার উপলক্ষ্যই হলো সামাজিক ও ধর্মীয় এই সব অনুষ্ঠানসমূহ। যেমনটি বিশ্ব ও দেশের একটি বড় অংশের নাগরিক তাঁদের পরিবার ও নিকটজনদের কাছে যেতে পারছে না। ঈদ উৎযাপনের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় হয়নি কখনো।

পশ্চিমা বা ইউরোপ-আমেরিকার সমাজ কাঠামোতে এগুলোর প্রচলন খুব কমই দেখা যায়। কারণ উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, আধুনিকতা, নগরায়ন, বাণিজ্যিকীকরণ, চরম শ্রম বিভাজন, ভোগবিলাসিতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সেসব দেশের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রক্তের সম্পর্কগুলোকে দুর্বল ভিত্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সে কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ভার্চুয়াল সম্পর্কের ভিতসমূহ সেসব দেশে অনেক শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে পেরেছে। যেমন ডে কেয়ার সেন্টার, শিশু কেয়ার, ওল্ড হোম, দাতব্য সংস্থা, মাদার ও ফাদার ডে প্রভৃতি।

পারিবারিক ও সামাজিক আবহের মধ্যে থেকে বেড়ে ওঠা মানুষের মধ্যকার সম্পর্কগুলো হৃদয়স্পর্শী হয়। এসব সম্পর্কগুলো নাড়া দেয় মানুষের গভীরের মনকে। মন গহীনের শব্দে, তা প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে মানব মনের আঙ্গিনায়। বাংলার ঈদ আনন্দ মানুষের মনকে সেই আনন্দের ঝর্ণা ধারায় ভাসিয়ে তোলে।

কোভিড-১৯ এর বিশ্বময় মহামারীর মধ্যে সে আনন্দ আজ অনেকটাই ফিকে। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বলছে ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ….. আজই পড়বি ঈদের নামাজ রে ভাই ঐ সেই ঈদগাহে।’ কিন্তু কবির সেই আহ্বান মুসলিম বিশ্বে তথা গোটা বিশ্বে এ বছরে দেখা যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক এই পৃথিবীকে মানুষ বিজ্ঞান ও তাঁর জ্ঞান দিয়ে অনৈতিকভাবে শাসন করেছে বছরের পর বছর। যত্রতত্র ব্যাপক হারে শিল্পায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণ তার অন্যতম প্রধান কারণ। এর প্রতিক্রিয়া বিশ্ব তার ওপর বসবাসরত প্রাণীকুল ও মানব জাতির ওপর নির্দয়ভাবে নিচ্ছে।

প্রকৃতির ভারসাম্য আনতে পৃথিবী বর্তমানে লকডাউনে রয়েছে। আমূল সংস্কারের কাজ চালাচ্ছে পৃথিবী। প্রাণীকুল ও প্রকৃতি বর্তমানে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। সাগর উপকূলে ডলফিনের অবাধ বিচরণ অথবা হাজার হাজার কচ্ছপের সাগরতীরে ডিম পাড়ার দৃশ্য প্রভৃতি এসবেরই উদাহরণ। নিশ্চয় আল্লাহের অশেষ নিয়ামতের এই পৃথিবী আমাদের জন্য বাসযোগ্য সুন্দর আবাসস্থল ফিরিয়ে দিবে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট, বিশ্বের সৃষ্টির রহস্য মানব জাতির নিকট নিদর্শন রূপে তুলে ধরেন। যাতে তাঁরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে।

বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালের ঈদের এমন উৎযাপন আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ন্যয়-নীতি, আদর্শ, নৈতিক, যৌক্তিক, আশাবাদী, বাসযোগ্য ও মানবিক বোধের নতুন পৃথিবীর প্রত্যাশা বিশ্ব উম্মার।


লেখকঃ চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্পাদক বাংলাদেশ স্কাউটস গোপালগঞ্জ জেলা রোভার।

ডিজিটাল বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসের ভূমিকা ও বাস্তবতা

আবু জাফর আহমেদ মুকুল
মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম


বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শিল্পবিপ্লবের ফলে। বর্তমান বিশ্বও টিকে আছে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে মোট তিনটি শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। এ শিল্পবিপ্লব-গুলো বদলে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ, বিশ্ব অর্থনীতির গতিধারা।

১৭৮৪ সালে পানি ও বাষ্পীয় ইঞ্জিনের নানামুখী ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল প্রথম শিল্পবিপ্লব। এতে এক ধাপে অনেকদূর এগিয়ে যায় বিশ্ব। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে একেবারেই পাল্টে যায় মানুষের জীবনের চিত্র।

কায়িক পরিশ্রমের জায়গা দখল করে নেয় বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি। শারীরিক শ্রমের দিন কমতে থাকে দ্রুততর গতিতে। এটিকে বলা হয় দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব। প্রথম শিল্পবিপ্লব থেকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রভাব আরও বিস্তৃত। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের ঠিক ১০০ বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত হয় ইন্টারনেট। শুরু হয় ইন্টারনেটভিত্তিক তৃতীয় শিল্পবিপ্লব।

ইন্টারনেটের আবির্ভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সময় তথ্যপ্রযুক্তির সহজ ও দ্রুত বিনিময় শুরু হলে সারা বিশ্বের গতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ম্যানুয়াল জগৎ ছেড়ে যাত্রা শুরু হয় ভার্চুয়াল জগতের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসছে এ ভার্চুয়াল জগতেরই আরও বিস্তীর্ণ পরিসর নিয়ে। যেখানে মানুষের আয়ত্তে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংস বা যন্ত্রের ইন্টারনেট, যা সম্পূর্ণ রূপেই মানবসম্পদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে! এ নিয়েই এখন তোলপাড় চলছে সারা দুনিয়াজুড়ে।

প্রযুক্তিনির্ভর এ ডিজিটাল বিপ্লবকেই বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটি প্রথম এপ্রিল, ২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মূলত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। এ বিপ্লবের ফলে নানামুখী সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে দেশের সামগ্রিক চালচিত্রে। যেমন- অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস, উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে বড় পরিবর্তন, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি, সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। এ বিপ্লব অর্জনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ক্লাউড কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক ভালো করেছে এবং বর্তমান বিশ্বের আধুনিক সব তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ব এখন জোর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জননেত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেওয়ার সময়ই আমাদের এই নতুন বিপ্লবে শামিল হতে সুযোগ করে দেন। বাংলাদেশও রয়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা দ্বিতীয় শিল্প যুগের।যার ফলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ অনলাইন ক্লাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ২৪ মার্চ, ২০২০ইং ইউজিসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা সাময়িক ভাবে পূরণ করার লক্ষ্যে শিক্ষকদেরকে অনলাইন ক্লাস নিতে বলা হয়। গত ৬ এপ্রিল, ২০২০ইং আবারও এক বিজ্ঞপ্তিতে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানায় ইউজিসি।

ইউনেস্কো রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিক্ষার্থী যার মধ্যে ১৭.৩৩ মিলিয়ন প্রাথমিক, ১৫.৮৬ মিলিয়ন মাধ্যমিক আর ৩.১৫ মিলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের ৪৬টি পাবলিক, ১০৫টি প্রাইভেট এবং ৩টি আন্তর্জাতিকসহ (ইউজিসি ওয়েবসাইট কর্তৃক প্রাপ্ত) মোট ১৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।

শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল প্রোগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে এই অনলাইন ক্লাস সরাসরি পরিচালিত হচ্ছে, যা দেশব্যাপী সব মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সেমিস্টারের ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কিছু কলেজেও সীমিত পরিসরে অনলাইন শিক্ষণ অ্যাপ্লিকেশন যেমন জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট বা সমমানের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে পাঠদান প্রক্রিয়া চালু রেখেছে ।

এদেশের সকল সেক্টরে অনলাইন ব্যবস্থার মতো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস করা জরুরি। করোনার এই পরিস্থিতিতে মানবিক শিক্ষক হওয়াটা খুব দরকার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার্থীদের সেসন জট নিরসনে নিম্নলিখিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেঃ

১) বাংলাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে এ বছর চলে যাবে। শিক্ষার্থীরা ১ বছরের সেসন জটে পড়বে এবং ৪ বছরের অনার্স ৫ বছরের বেশি অতিক্রান্ত হবে। সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রেও তাদের বয়স কনসিডার করা হবে না । আবার, অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে অনেকের ভ্রান্ত ধারনা আছে সকলকে উপস্থিতি থাকতে হবে, বিষয়টা সে রকম নয়। ক্লাসটি ও Course Materials সকল শিক্ষার্থীর ব্যাচ, Zoom ও Youtube এ সংরক্ষিত থাকবে। তাই যে কোন সময় একজন ছাত্র রেকর্ডকৃত ক্লাস ও Course Materials দেখে নিতে পারবে।

২) আমার কাজের অভিজ্ঞতা দেখে দেখছি প্রত্যেকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩% অস্বচ্ছল শিক্ষার্থী রয়েছে । এমনকি প্রায় অধিকাংশ সাহায্য প্রার্থীরা সামাজিক মাধ্যম এবং স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে আর্থিক সাহায্য চেয়েছেন। তাই যারা বলছেন ব্যক্তিগত ল্যাপটপ নেই তারা স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারেন। কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে, বাংলাদেশে স্বল্পতার মধ্যেও চালু হওয়া অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের মতো শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমরা স্মার্টফোনটি শুধু সামাজিক যোগাযোগ হিসেবে ব্যবহার না করে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করতে পারি।

৩) যে সকল শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের Excuse দিয়ে ক্লাস করতে চায় না তারাও কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে, তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং প্রকৃতপক্ষে তারা দরিদ্র নয়। তবে এটি সত্যি যে, মান-সম্মানের ভয়ে প্রকৃত দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা সামাজিকভাবে কখনো বলতে চায় না তারা দরিদ্র।

৪) অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন অনলাইন শিক্ষার জন্য প্রধান বাধাঁ- ব্যান্ডইউথের গতি আর দাম। বাংলাদেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম-বেশি নিম্ন আয়ের বা দরিদ্র শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের কোন মোবাইল অপারেটরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তি করে প্যাকেজ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে এবং চুক্তি অনুযায়ী ব্যান্ডইউথের গতি বিষয়ে নিশ্চয়তা দিবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি। তবে সরকারের কাছে, অনেক অব্যবহ্নত ব্যান্ডউইথ রয়েছে যা কর্তৃপক্ষ চাইলে শিক্ষার্থীদের অনলাইন কার্যক্রমে ব্যবহার করতে পারে। এমনকি, অনেক মোবাইল কোম্পানির কাছে সরকার কয়েক হাজার কোটি বকেয়া টাকা পাবে। সরকার চাইলে সেটাও করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের কল্যানে সমন্বয় করা সম্ভব।

৫) অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের অনেকের অংশগ্রহণের সক্ষমতা না থাকা এবং অনেকের অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের লিস্ট করে আর্থিক সাহায্য প্রদান করছেন। এমনকি, প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষক, এলামনাই এসোসিয়েশন, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানসহ স্থানীয় প্রশাসন অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য এগিয়ে এসেছেন।

৬) অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনির্ধারিত এই ছুটির সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পুষিয়ে নিতে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ অন্যান্য সময়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া শুভংকরের ফাঁকি বলে আমি মনে করি এবং যা গুনগত শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সেসনজট নিরসনের জন্য কোন প্ল্যান উপস্থাপন করেনি এবং কোন কোন প্রকার জরিপ না করে বলছে তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও স্মার্ট ফোন নেই যা খুবই দুঃখজনক একটি বিষয়।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জরিপ-২০১৯ মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৮১ লাখ। এদের মধ্যে ৯ কোটি ২৪ লাখ মোবাইল ফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী এবং বাকি ৪০ হাজার ওয়াইম্যাক্স ব্যবহারকারী। মুঠোফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএ, দেশের প্রায় ৬০% লোক স্মাট ফোন ব্যবহার করে। আগামি ২০২০ সালে নতুন স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৭ নম্বরে থাকবে বাংলাদেশ।

৭। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট সংযোগসহ প্রযুক্তিগত অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকার বিষয়টি বলা হয়েছে যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের নির্বাচনি ইশতেহারের সাথে সাংঘর্ষিক বলে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্লাটফর্ম হিসেবে অনলাইন লার্নিং ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করা দরকার।

৮) যারা ভাবছেন, ঈদের ছুটির পর অবস্থা স্বাভাবিক হলে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সকল কিছুর সমস্যা সমাধান করে ফেলবেন । তারা প্রকৃতপক্ষে অন্ধকারে আছেন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে যেখানে আগামি এক বা দুই বছরের জন্য অনলাইন ক্লাসের পরিকল্পনা করছেন। সেখানে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় Physically Class নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছেন। তবে এটি সত্যি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের Physically Class নেওয়ার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক করোনায় ঝূঁকি বাড়ার আশংকা রয়েছে।

৯) বিশ্বব্যাপী শিক্ষাব্যবস্থায় ইনস্ট্রকটিজম, কনস্ট্রাকটিজম এবং কানেক্টিভিজম এই তিন ধরেন ক্লাসরুম শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগেুলো এখনো ক্লাস লেকচার বেইজ বা ইনস্ট্রকটিজম এবং মুখস্থ ভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে পড়ে রয়েছে। এমনকি পাশের দেশে ভারতে কনস্ট্রাকটিজমে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কনস্ট্রাকটিজম মূলত সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক লার্নিং।

১০) চলমান সেমিস্টারে যাদের ফাইনাল পরীক্ষা বাকি আছে। তাদেরকে ইউজিসি নির্দেশ অনুযায়ী, বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির মাধ্যমে প্রশ্ন প্রণয়ন করে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অনেকে ছাত্র ভাবছেন, এ সেমিস্টারে পরীক্ষা ছাড়া অটো গ্রেড পাবেন কিংবা ক্লাস কম করে পরীক্ষা দিবেন! এ আশা কেবল স্বপ্ন দেখার মতো বাস্তবতা নয়।

১১) অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে গুগল ফর্ম, গুগল ক্লাসরুমসহ আরও বেশিকিছু থার্ড পার্টি অ্যাপস আছে যা দিয়ে আগে থেকে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যায়, এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী ওই অ্যাপসটি বন্ধ করলে বা একই সময়ে অন্য কোনো এপস চালু করলে বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর না করতে পারলে তাদের পরীক্ষাটি বাতিল বলে গণ্য হয়। সুতরাং, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ খুব কম থাকে। একই পদ্ধতিতে অনলাইনে শিক্ষার্থী ভর্তি ও মূল্যায়ন সম্ভব। ইমেইলের মাধ্যমে এসাইনমেন্ট নেওয়া এবং প্রেজেন্টেশন সরাসরি ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে।

১২) অনলাইন এসেসমেন্ট এর ক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে সতর্ক থাকতে হবে । আমাদের শিক্ষার্থীরা যেহেতু গ্রামীন এলাকায়ও থাকে সেহেতু এসাইনমেন্ট বেশি ওয়ার্ডে না দিয়ে গবেষণার মতো মূল অ্যাবস্ট্রাক্ট এর মতো ১০০ শব্দে দেওয়া যেতে পারে। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী স্মার্ট ফোন দিয়ে টাইপ করে যাতে সহজে এসাইনমেন্ট টি করতে পারে।

১৩) দেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ধরনের একাডেমিক, টেকনিক্যাল বা প্রশাসনিক সহযোগিতার জন্য কোন MoU নেই। যার করোনার মহামারিতে অনলাইন শিক্ষাক্রমের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সহযোগিতা করতে পারছে না। তবে এ বিষয়টি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষে আইকিউসি বা ইউজিসি এগিয়ে নিতে পারে।

১৪) বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন লার্নিং বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটর কোম্পানি সমন্বয়ে আহবায়ক কমিটি গঠন করে এবং প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিক্যাল ও মনিটরিং কমিটি করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

১৫) শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি, মেডিকেল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয় যেখানে ব্যবহারিক ক্লাস রয়েছে সেখানে সমস্যা রয়েই গেল। এক্ষেত্রে তত্ত্বীয় কোর্স চালানো সম্ভব হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাবহারিক ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না। তবে করোনা পরিস্থিতি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বাভাবিক না হলে চলতি সেমিস্টারের ব্যাবহারিক কোর্স সমূহ পরবর্তী সেমিস্টারে অফার করার ব্যবস্থা করার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে একাডেমিক বিশেষজ্ঞরা একটি সমাধান বের বের করতে পারবেন বলে মনে করি।

মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে প্রতিটি ঘটনা থেকে কিছু শেখে। সম্প্রতি, উচ্চ আদালতে শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে আদালতের বিচার কার্যক্রম শুরু করছে যা প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। বহির্বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটামুটি সম্পূর্ণরূপেই একটি আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাসে পাঠদান প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কিছুটা সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করলে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায় খুব সহজে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে তাতে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে আসা উচিত। আশা করি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও নীতি নির্ধারকগণ সে পথে হাঁটবে।


লেখকবৃন্দ: শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে এর শিক্ষক।

ভাইস-চ্যান্সেলর ও বিশ্ববিদ্যালয় কড়চা

মো. মজনুর রশিদ


গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি ) এ অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি উচ্চ শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির কলবর বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ, শেখ হাসিনা কৃষি ও আইসিটি ইনস্টিটিউট এবং ৮টি অনুষদসহ ৩৪ টি বিভাগে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।

বিদেশী শিক্ষার্থীসহ এখন প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। রয়েছে ৫ টি আবাসিক হল। প্রায় ৫৫ একর ভূমি বেষ্টিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আইন পাস হয় ৮ জুলাই ২০০১ সালে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে সেই বছরের ২১ জুলাই প্রকল্পটি স্থগিত ঘোষণা করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক। পরের বছর ২০০২ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকল্পটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

দীর্ঘ সময় পরে নভেম্বর ২০০৯ সালে প্রকল্পটি পুনরায় চালু করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি আলোর মুখ দেখে এবং অবকাঠামোগত কার্যক্রমের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘসূত্রতা থাকলেও উক্ত উন্নয়ন কার্যক্রম বর্তমানেও অব্যহত রয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২৬ ডিসেম্বর ২০১১ সাল থেকে। ক্যাম্পাস ও একাডেমিক কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ জানুয়ারি ২০১৩ সালে।

নবীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রায় ৭/ ৮ বছর পর ২০১৯/২০২০ সালে এসে বিভিন্ন ঘটনা-অঘটনার মধ্য দিয়ে সারা বাংলাদেশে বেশ পরিচিতি লাভ করে। সে পরিচিতি যতটা না ছিলো সুখকর তার চেয়ে ঢের বেশি দুর্ভাবনার ও নিরব সংঘাতের। আন্দোলন, অবরোধ, ক্লাস বর্জন, ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলানো, অনশণ, অস্থান কর্মসূচি প্রভৃতি ঘটনার কারণে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির হয়ে পরে (দৈনিক সংবাদপত্র, বশেমুরবিপ্রবিসাস সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ২০১৯)।

এসব ঘটনাতে চরম ব্যাঘাত ঘটে শিক্ষা কার্যক্রমে। অনেকে মনে করে এ সবই ছিল বিগত ভাইস-চ্যান্সেলের হটকারি সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত পরিণতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের একক সিদ্ধান্তের নানা উদ্ভট কর্মকান্ড, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার আতুর ঘরে পরিণত হয়েছিল বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ পাই সেই সময়ে।

অপর পক্ষে ছিলো কিছু সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি বর্গের নিরবিচ্ছিন্নভাবে কার্যকরী প্রশাসনকে অসহোযোগিতা করার বাস্তব চিত্র! অথচ একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশ ও দেশের বাহিরে বেশ সুনাম অর্জন করে তার মান সম্মত উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠরূপে পরিচালনার দক্ষতার জন্য। সে সবই আজ মরিচীকার মতো অতীত।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পরা করোনা ভাইরাস বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাতে এনেছে ছন্দ পতন ও বিপর্যয়। বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠতে চেষ্টার কমতি নেই সরকার প্রধানের। মহামারীর এমন সময়ে যখন সবকিছু বন্ধ তখন বশেমুরবিপ্রবির ক্যাম্পাসসহ দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়গুলো শিক্ষা কার্যক্রমের বর্তমান হালচাল নিয়ে শঙ্কিত । কেননা দীর্ঘ বন্ধের পরে ব্যাহত হওয়া শিক্ষা কার্যক্রমকে কিভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় সেই ভাবনা এখন সবার মাঝে।

শিক্ষা বান্ধব, যোগ্য নেতৃত্ব, প্রশাসনিক দক্ষতা, সাধারণ, সৎ, নিষ্ঠাবান, জবাবদিহিতা, দুরদর্শীতা, নিয়মানুবর্তিতা, ছাত্র-শিক্ষক বান্ধব ও দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ মেধাবী ভাইস চ্যান্সেলর পারবেন করোনা দুর্যোগ পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঠিকভাব পরিচালনা করতে। কিন্তু গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর নামে ও তাঁরই জন্ম ভূমির ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আজ ৮ মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও স্থায়ী কোনো ভাইস-চ্যান্সেলর নেই। বিষয়টি সুষ্ঠুরুপে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে অন্তরায়। দেশের ক্লান্তিকালীন সময়ে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। স্থায়ী সর্বোচ্চ অবিভাবক প্রাপ্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে সামগ্রিক শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে বলে অনেকেই মনে করে।

দৈনিক সংবাদপত্র ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বহুল প্রচারিত বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জের ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে সংগঠিত হয় তৎকালীন ভিসি অপসারণ আন্দোলন। ভিসি অপসারণের উক্ত আন্দোলন ছিলো ক্যাম্পাসের সব ধরনের অনিয়মের বিপক্ষে। আপাত দৃষ্টিতে বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন এনে শিক্ষা বান্ধব পরিবেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি, প্রগতি ও বঙ্গবন্ধুর সত্যিকারের আদর্শ ও কল্যাণকর ক্যাম্পাসের প্রত্যাশা পূরণই ছিলো সে সব কিছুর প্রধান লক্ষ্য।

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে শুরু হওয়া ভিসি অপসারণ আন্দোলন ৩০ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন ভিসির পদত্যাগের মাধ্যমে শেষ হয়। এবং আন্দোলন সফল হওয়াতে আনন্দ মিছিল ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা। কঠোর শাষণ ও শৃঙ্খলা মুক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে মুক্ত চিন্তা, বাক ও অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, অবারিত জ্ঞান চর্চার স্বাধীনতা, নির্বিঘ্নে ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি, নানা বুদ্ধিভিত্তিক, সামাজিক, সাংকৃতিক ও জেলা সংগঠনের স্বাচ্ছন্দে নিজেদের কর্মযোগ্য পালনের উচ্ছ্বলতা প্রভৃতি কর্মযজ্ঞ ফিরে পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস।

আপাতদৃষ্টিতে সফল আন্দোলন পরবর্তী কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ছিলো অত্যন্ত তিতে। স্বল্প পরিসরে উন্নয়নমূলক ও সংস্কারের কাজ ব্যতিত চরম প্রত্যাশা প্রাপ্তির ছাত্র-শিক্ষকের এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রাপ্তির বিষয়সমূহের অধিকাংশ আজও আলোর মুখ দেখতে পায়নি। শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ ও খতের স্থানটি তাই আজও দগদগে হয়ে রয়েছে। সেখান থেকে আবারও নতুন কোনো ক্ষতিকর ভাইরাস ছড়িয়ে পরার বিভিন্ন উপস্বর্গ দেখা দিচ্ছে ক্যাম্পাসের আঙ্গিনায় ও তার বাহিরে।

আন্দোলন পরবর্তী শিক্ষার্থীদের সবক্ষেত্রে আন্দোলনের দাবিকৃত বিষয়াবলির সমাধান বা অধিকার ফিরে পাবার আনন্দ তাঁদের মধ্যে কমই রয়েছে বলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করে। স্বরণ রাখতে হবে আন্দোলন সফল হওয়ার তৃপ্তি আর আন্দোলনের দাবী পুরণের স্বপ্ন এক নয়। সব স্তরের অধিকার বাস্তবায়নের সুখের হাসিই হতে পারে সত্যিকার আন্দোলনের স্বার্থকতা।

৭ অক্টোবর ২০২০ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন জ্যেষ্ঠ প্রফেসর চলতি দায়িত্বে ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ পেলেও দায়িত্ব পালনে অনেক সীমাব্ধতা থাকাতে তিনি জটিল ও গুরুত্বপুর্ণ বিষয়াবলির সমাধানে আসতে অনেক ক্ষেত্রে কম সক্ষম হচ্ছেন। বিষয়টি অনেকটা ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দারের মতো অবস্থা। চলতি দায়িত্বে থাকা ভাইস-চ্যান্সেলরকেও স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যদি সরকার তাঁকে উক্ত পদে যোগ্য মনে করেন।

সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুনাম রয়েছে ক্যাম্পাসে। অথবা দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক যোগ্য প্রফেসর রয়েছেন, সেখান থেকে যোগ্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের বিষয়টি দ্রুত সমাধানে না আসার ফলফল হতে পারে চরম বেমুরাং ও বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য আত্মঘাতী। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়বস্তুর সমাধান প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানটিতে সুষ্ঠভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য।

১. অমিমাংসিত হয়ে পরে রয়েছে ইটিই বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ইটিই বিভাগ থেকে ইইই বিভাগে রূপান্তরিত হবার মতো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়। বেশ কিছু দিন আগের আন্দোলনের মুখে বিভাগের সব ধরণের ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। আমরণ অনশণ ও আন্দোলনের ৯১ তম দিনে ইটিই বিভাগের শিক্ষার্থীরা (তথ্য সুত্র: ১৫ জানুয়ারি, ২০২০, বশেমুরবিপ্রবিসাস)। বিষয়টি বর্তমানে তদন্তের বেড়াজালে আটকে রয়েছে।

২. পূর্বের ভাইস-চ্যান্সেলরের বিভিন্ন সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত পার্ট টাইম স্টাফরা ৮ নভেম্বর ২০১৯ থেকে চলমান পার্ট টাইম কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। গত আগস্ট ২০১৯ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ১০ মাস বেতন ছাড়া রয়েছে ১৭৬ জন স্টাফ। তাঁদের অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক ও দুর্দশাগ্রস্থ।

৩. ইতিহাস বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ থেকে আন্দোলনে রয়েছে উক্ত বিভাগের ৪২৪ জন শিক্ষার্থী। ইউজিসি কর্তৃক নতুন ছাত্র উক্ত বিভাগে আর ভর্তি না করার নির্দেশ প্রদান করেন (৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।

৪. শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি নেতিবাচক জবাবদিহিতার ঘটনা, শিক্ষক- ছাত্র সম্পর্কের চরম ভয়ংকর আস্থার অবনতি ও কখনো কখনো ক্লাস বর্জনের ঘটনা ছিলো, নিত্যদিনের ঘটনা করোনা ভাইরাসের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত। শিক্ষকদের তিন দিনের কর্ম বিরতি (তথ্যসুত্র: ২০/০১/২০২০, কালের কন্ঠ)

৫. আন্দোলন পরবর্তী প্রশাসনিক শিষ্টাচারের বাহির থেকে প্রশাসনিক অনেকগুলো পদের রদবদল।

৬. উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের আপগ্রেশন ও প্রমোশন না হওয়ার দিকটি অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য। সেক্ষেত্রে শিক্ষকগণ হয়েছেন আর্থিক ও মর্যাদাগত দিক থেকে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ।

৭. পাঠদানের শ্রেণি কক্ষ ও ল্যাব রুমের ভীষণ সংকট। শিক্ষার্থীদের শরীর ও মননশীল বিকাশের ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন অতিব জরুরী।

৮. অনেক বিভাগের শিক্ষক স্বল্পতা ও দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক থেকে শিক্ষক সংকট রয়েছে প্রকট, সেই সাথে রয়েছে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন সংকট।

৯. অবকাঠামোগত উন্নয়নে স্থবিরতা যা সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত করছে।

১০. শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি বিষয়সমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে ছন্দপতন ঘটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এসকল বিষয় ছাড়াও অন্যন্য বিষয়গুলোর সঠিক সমাধান করা বর্তমানে জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পূর্বের ভিসির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে যা বিভিন্ন সময়ে অনলাইন মিডিয়া ও সংবাদপত্রে উঠে এসেছে । বর্তমানে এসব অনেক বিষয় দুদকের তদন্তাধীনে রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালের আন্দোলনের সময় ইউজিসি কতৃক দ্রুত পর্যবেক্ষণের সুপারিশে তৎকালীন ভিসির পদত্যাগের সুপারিশ করে। এর পরেই ভিসির পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে (৩০/০৯/২০২০, বিভিন্ন সংবাদ মিডিয়া)।

এতোকিছুর পরেও ২০১৯/২০ শিক্ষা বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করে ভর্তি কার্যক্রমও শেষ করা হয়েছে। এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে বহুল কাঙ্খিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন (১০ মার্চ, ২০২০)। প্রতিষ্ঠানটির অনেক দিকের অবস্থান ভঙ্গুর, নাজুক ও ভয়ঙ্কর দ্বান্দ্বিক! এসব সমস্যার সমাধানের একমাত্র উপায় বলে সকলেই মনে করে একজন যোগ্য এবং স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলরের নিয়োগ। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ দিন ধরে চলতি দায়িত্বে থাকা ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন। এবং স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর না থাকাতে জটিল সব সমস্যার পাহাড় জমা হতে থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানের। সেগুলোর সমাধান এসেছে স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের মাধ্যমে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় দুটি শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং অব্যাহত রয়েছে তাদের সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম। তার আগে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রক্ষার অন্যতম কারণ। গোপালগঞ্জের পরে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অপসারণের আন্দোলনের যে ভাইরাস দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পরেছিল ঠিক তখনই প্রধান মন্ত্রীর সুচিন্তিত বক্তব্যের মাধ্যমে স্থিমিত হয় সেসব অপচেষ্টা।

তার সাথে যথাযথ দায়িত্ব পালনে সতর্ক ও সজাগ হয়ে ওঠেন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরগণ। সামগ্রিক দিক পর্যবেক্ষণ করে বলা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ভাইস -চ্যান্সেলর ছাড়া সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা কষ্টকর ব্যাপার।

কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবার স্বল্প আয়ের শিক্ষার্থী ও স্টাফদের পাশে মানবতার হাত বারিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বশেমুরবিপ্রবি গোপালগঞ্জ ক্যাম্পাসও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এতো নেতিবাচকের পরেও কোভিড-১৯ তাঁদেরকে একত্রিত করে দেখিয়ে দিয়েছে প্রয়োজনে মানুষ ভালো কিছুর উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা গুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

১. শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে গঠন করা হয় ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি ফান্ড’ (৩১ মার্চ, ২০২০)। উক্ত ফান্ড থেকে চলমান রয়েছে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা প্রদান করা।

২. করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় সহায়তার নিদর্শন হিসেবে প্রধান মন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একদিনের সমপরিমান বেতনের অর্থ প্রদান।

৩. শিক্ষক সমিতি কর্তৃক শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তি ও মানবিক স্বাস্থ্য সেবা সহায়তা প্রদান।

৪. ২০০ শিক্ষার্থীর পাশে দাড়াচ্ছেন বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষকরা (৫ মে, ২০২০)। ৫. শিক্ষকদের হটলাইন সেবা চালু (৬ মে, ২০২০)।

৬. শিক্ষার্থীদের মেস ও বাসা ভাড়া মওকুফ করার জন্য বিশেষ কমিটি গঠন (৭ মে, ২০২০)।

৭. ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের সহায়তায় দরিদ্র ও অসহায় কৃষকের পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দেওয়ার চমৎকার উদ্দ্যোগ ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ (মে, ২০২০)।

৮. ১৭৬ জন পার্ট টাইম কর্মচারীদের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছেন শেখ নাঈম (২১ এপ্রিল, ২০২০)।

৯. বশেমুরবিপ্রবি ও গোপালগঞ্জ জেলা রোভার কর্তৃক লিফলেট বিতরণ, জন সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম, হ্যান্ড সেনিটাইজার ও হাত ধোঁয়া সাবান বিতরণ কর্মসূচী পালন করা (৪ মার্চ, ২০২০)।

১০. গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সহায়তায় হ্যান্ড সেনিটাইজার তৈরি ও তা বিতরণ করে বশেমুরবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা (২৩ মার্চ,২০২০) প্রভৃতি কর্মকান্ড ছিলো মহতি ও প্রশংসনীয় উদ্দ্যোগ এবং করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্থ ও অসহায় শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার লক্ষ্যে।

এতোসব ভালো উদ্দ্যোগের মাঝে ছাত্র কল্যাণ ফান্ড নামে একটি বড় অংকের ফান্ড রয়েছে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই ফান্ড থেকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারীর এমন দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য জোর দাবী রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক ফান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনের কার্যকরী কর্মপন্থা ও সুনজর প্রয়োজন।

মনে রাখা প্রয়োজন, কিছুদিন আগে জেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে করোনা মহামারী মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রনোদনা, ৯ হাজার কোটি টাকার কৃষি উপকরণে ভুর্তুকী প্রদান এবং ৭২ হাজার কোটি টাকা ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ প্রনোদনা ঘোষণা করেছেন। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণই হচ্ছে এসব পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।

বঙ্গবন্ধুর পূণ্যভূমিতে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি সময় অতিবাহিত করছে নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে। ইউজিসি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এসব বিষয়ে অবহিত রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। দীর্ঘ দিনের অবহেলিত ভাটির এই অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি এ অঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার আশার আলোর প্রদ্বীপ। বিশ্ববিদ্যালয়টির এসব ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে পত্র পত্রিকাতে সংবাদ ও নিবন্ধও প্রকাশ হয়েছে। প্রায় বছর হতে গেলেও আজ অব্দি পর্যন্ত স্থায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের প্রত্যাশায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তরের পরিবার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিবে। প্রাণ চঞ্চল্য হয়ে ওঠবে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কক্ষ ও আঙ্গিনা। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে এক দিনের জন্যও যেনো শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ না থাকে সে ব্যাপারে সকলকে যত্নবান হতে হবে। প্রাণ প্রিয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জটের দুর্ভাবনা থেকে চিন্তা মুক্ত রাখতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে উদ্দ্যোগী হবার এখনই সময়। প্রকৃতিক নিয়মে বাধ্য হয়ে অনেক দিনের শিক্ষা বিরতির মধ্যে রয়েছে তারা।

সে সব সমস্যা থেকে শিক্ষক সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকা পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঠিকভাবে পরিচালানায় সহযোগিতা করে একটি সুন্দর দেশ বিনির্মান করতে। প্রধান মন্ত্রীর নিকট একটাই নিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের অমীয় সম্ভাবনার দিকটি সদয় বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ নামে ও প্রধান মন্ত্রীর নিজ জেলায় প্রতিষ্ঠিত সর্বোচ্চ জ্ঞান চর্চার এই বিদ্যাপিঠের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

অতি দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরী। তা না হলে হাজার হাজার দরিদ্র শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন চরম ক্ষতির ও দুর্ভাবনার মধ্যে নিপতিত হবে। এমন অবস্থার মুখোমুখি হবার কারোরই কাম্য না। প্রত্যাশা থাকবে উচ্চ শিক্ষার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সব বাঁধা পেরিয়ে জ্ঞান আহরণ, জ্ঞান বিতরণ ও দেশ গড়ার তীর্থ ভূমিতে পরিণত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গণ।


লেখকঃ চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ স্কাউটস গোপালগঞ্জ জেলা রোভার।

বাংলার আকাশে নক্ষত্রের পতন

আবু জাফর সালেহ


মাত্র সতেরো দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ হারাল তার পরম দুই রত্ন কে। জাতীয় অধ্যপক ড. জামিলুর রেজার পর বিদায় নিলো ড. আনিসুজ্জামান। স্বাধীনতা বাংলার সমস্ত বড় ভৌত কাঠামোর মধ্যে যেমন অমর রবেন জামিলুর রেজা স্যার তেমনি আনিসুজ্জামান স্যারও বাঙ্গালীর অভ্যান্তরীণ সাহিত্যআত্মায় বেঁচে রবেন চিরকাল।

জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। লেখালেখির হাত ছিল মা সৈয়দা খাতুনের পরবর্তী জীবনে আনিসুজ্জামানের উপর এর প্রভাব পরে।

স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, মেয়ে রুচিতা জামান ও শুচিতা জামান এবং ছেলে আনন্দ জামান নিয়েই ছিল তার স্বর্গ।

“রাষ্ট্র ভাষা কি ও কেন” লিখলেন ভাষা আন্দোলনের সময়ে। করলেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান অংশগ্রহণ , ১৯৭১ সালে করলেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনোত্তর বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বক্তৃতা গুলো অনেকটি হাত হাতেই লিখা। চষে বেড়িয়েছেন কলকাতা থেকে শিকাগো পর্যন্ত নিজের জ্ঞানের ঝুড়ি সমৃদ্ধ করতে।

কলকাতার পার্ক সার্কাসে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ৪৭ দেশভাগের পর তিনি খুলনা জিলা স্কুলে ও ঢাকায় প্রিয়নাথ হাইস্কুলে পড়েন।১৯৫১ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতকে ও ১৯৫৭ সালে স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। পিএইচডি ডিগ্রি করেন ‘ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা’ নিয়ে। ১৯৫৬ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্র জীবনের মত তার পেশাগত জীবনেও তিনি সাফল্য। মাত্র ২২ বছর বয়সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু। এরপর ১৯৬৯ জুনিয়র রিডার হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদাকে শিক্ষা কমিশনের সদস্য পদে কাজ করেন। কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন ৭৪ সালে।

১৯৮৫- ২০০৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা করেন। এরপর সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে স্বরূপের সন্ধানে, পুরোনো বাংলা গদ্য, মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, ইত্যাদি।

তিনি ১৯৮৫ সালে ‘একুশে পদক’, ২০১৫ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পদকে ভূষিত করে। এ ছাড়া তিনি দুবার আনন্দবাজার পত্রিকার ‘আনন্দ পুরস্কার’, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি-লিট’, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী’ পদক পান।

৮৩ বছরের বর্ণিল জীবনের ইতি টানে ১৪ মে বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

তিনি যেমন শহীদুল্লাহ্, মুনীরের মত শিক্ষাগুরু পেয়েছিলেন তেমনি রেখেও গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ শত যোগ্য শিক্ষার্থীদের। দেশ-বিদেশে তার এই গুণগ্রাহীরাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ।


লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনা যোদ্ধাদের কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই

অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা


১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিলো, দু’লক্ষেরও অধিক মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছিলো। বাঙালি জাতি সেই বীর শহীদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে সম্মান জানিয়েছেন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে আমরা বিজয় অর্জন করেছি।

২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে বাঙালি জাতি আর একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। বাঙালি জাতি শুধু একা নয়। সারাবিশ্ব আজ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ যুদ্ধে আজ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে। যুদ্ধ এখনও থামেনি, কতদিন চলবে তাও বুঝতে পারছি না।

যাঁরা এ যুদ্ধে বিশেষ করে বাংলাদেশে সম্মুখ সমরে আছে, তাঁদের প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা। বিশেষত যে সকল ডাক্তার, নার্স, আয়া সরাসরি কোভিড-১৯ এর সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করছেন, তাঁদেরকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এঁদের সঙ্গেই আছেন সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ, সামরিক বাহিনী, র‌্যাব এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তাঁদের অবদানও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

সাংবাদিক বন্ধুরা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায়, পাড়া-মহল্লায়, হাসপাতালে করোনা বিষয় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছেন তাঁদের প্রতিও আমরা কৃতজ্ঞ। যে মুহূর্তে দাফন করবার জন্য নিকট আত্মীয়রা এগিয়ে আসছেন না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ এগিয়ে আসছেন, তাদেরকেও আন্তরিক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই তাদেরকেও যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আমরা মানসিকভাবে আপনাদের সঙ্গে আছি এবং থাকবো। এ যুদ্ধে জয়ী আমরা হবোই।


লেখকঃ উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বুয়েটের ছাত্র হত্যা প্রসঙ্গে: শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা

আরিফুজ্জামান রাজীবঃ বুয়েটের একজন ছাত্রকে গত ৬ তারিখ রাতে হত্যা করা হলো।এ ঘটনা সারা বাংলার মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। আমরা যারা প্রবাসে আছি দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশের এরূপ মর্মান্তিক ঘটনা অামার মতো আরও অনেকেরই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। কি বিভৎস ঐ ঘটনা! কি মর্মান্তিক!

হলের ২০১১ কক্ষে রাত আনুমানিক ৮:৩০ থেকে ৩টা পর্যন্ত চললো অমানুষিক নির্যাতন। কেউ এগিয়ে এলো না? কেউ তাকালোও না? মরার পরেও কেউ ঘুরে দাঁড়ালো না? খুনিরা হল প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করলেন, কীভাবে আলামত নষ্ট করা যায়? কীভাবে এই ঘটনাটাকে অন্যদিকে নেয়া যায়?

এই পুরো ঘটনার জন্য কে বা কি দায়ী হতে পারে? আমাদের শিক্ষকদের এখানে দায় কতটুকু?

আমার ৩.৫ বছর শিক্ষকতা আর ৬ বছরের পড়াশুনার জীবনে একটা জিনিস খেয়াল করেছি, ছাত্র-ছাত্রীদের এই অন্যায় করা, অন্যায় দেখলে চুপ করে থাকা, নিজের স্বার্থের দিকে আগে নজর দেয়া, এগুলোর জন্য মূল দায়ী শিক্ষক সমাজ আর কিছুক্ষেত্রে পরিবার। ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিক বিকাশের পেছনেও মূল অন্তরায় শিক্ষকদের মানসিক সমস্যা, সাথে পরিবারিক অসঙ্গতি।

আবরারের ঘটনা সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সম্পর্কটা আসলে স্বার্থের, ভীষণ দুর্বল ও মেকি। একটি ছাত্রকে হলে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হলো অথচ হল প্রভোস্ট জানেনই না তার হলে কী হচ্ছে বা জেনেও মাথা ঘামায় না। এ দায় কার??

শুধু শিক্ষকরা বললে কিছুটা ভুল হবে মোটামুটি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটা প্যারামিটারে আমরা মেপে থাকি, তা হলো রেজাল্ট ভিত্তিক পড়াশুনায় ভালো ছাত্র-ছাত্রী আর খারাপ ছাত্র-ছাত্রী। যার সিজিপিএ বেশি সে ভালো ছাত্র আর যার সিজিপিএ কম সে খারাপ ছাত্র বা ছাত্রী। এই শ্রেণী বিন্যাসের পর, শুরু হয় আসল খেলা।

এই সিজিপিএ বেশি পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রীটিকে মানসিকভাবে বিকালঙ্গ, স্বার্থপর, লেজুড়বৃত্তিক মানুষ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। সে যেন বই ছাড়া অন্য কিছু না বুঝে, তাকে অমুক হতে হবে, তমুক করতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটা উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে সুবিধা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ বা অন্য কোন সামাজিক অসংগতি নিয়ে যদি কোন ছাত্র আন্দোলন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝের সারির ছাত্র-ছাত্রীরা সামনে চলে আসে, শেষের সারির গুলো ব্যবহার হয় রাজনৈতিক দল বা বড় ভাই দ্বারা, আর ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র-ছাত্রীরা হয় মাথা লুকিয়ে রাখে, নয়তো কোনো অংশগ্রহনই থাকে না। আর যদি ভুল করে সামনের সারির কোন ছাত্র বা ছাত্রী সামনে চলে আসে, তখন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক তাকে একা একা ডাকে। তাকে বুঝানো হয়, এই আন্দোলন তোমার জন্য না, তুমি পড়বে, তুমি আমাদের সম্পদ, তোমাকে সেটা অনুধাবন করতে হবে, ব্লা ব্লা ব্লা।

এসব বলে ছেলেটার/মেয়েটার যে কি উপকার হলো, আমি জানি না। কিন্তু ছেলেটার/মেয়েটার সমাজের, আমাদের যে কি ক্ষতি হলো তা আমি বুঝতে পারি। ঐ ছেলেটা মানসিকভাবে শেষ, স্বাভাবিক ভালো মন্দ বুঝার জ্ঞান সে হারিয়ে ফেলে। গুরুর সাথে তার একটা স্বার্থের সম্পর্ক তৈরি হয়। তার মাথায় ঢুকে গেল, যদি এসব কাজে না যাই, ঐ শিক্ষক আমার জন্য সুপারিশ করবে চাকরি বা অন্য কোথাও। সে আবার শিক্ষক হলে আবারো এমন বহু ছাত্রকে মানসিক বিকালঙ্গ করে ফেলবে। এভাবে পুরো সমাজে অাজ তিন ভাগে বিভাজিত হয়ে গিয়েছে । এক তথাকথিত খারাপ ছাত্র, অল্প সংখ্যক মানুষ যারা এধরনের শিক্ষক বা পরিবারের বলয় থেকে বের হতে পারছে, আর ঐ শ্রেণীর যারা বিকালঙ্গ বানাচ্ছে সেটা শিক্ষক ও পরিবারের সদস্য দুইই হতে পারে।

এবার আমরা আবরারের ঘটনার দিকে চোখ ফেরাই। হলের ঐ ঘটনা নতুন না, সবাই জানতো কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনি। শিক্ষকদের বলা হলে তারা বলতো, এ নিয়ে তোমরা কেন চিন্তা করছো, তোমরা ভালো ছাত্র, বুয়েটে পড়ো। কিছু ছাত্র নষ্ট হয়ে গেছে, ওদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করো না। বরং আরো দুইটা নতুন প্রোজেক্ট বা কাজ করো, দেখবে এগুলো আর মনে থাকবে না।

এভাবে দিনে দিনে পুরো হলের ছাত্রদের মানসিক বিকালঙ্গ করা হয়েছে। আর ঐ অল্পকয়জন গুণধর দেখেছে, তাদের পেছনে বিশাল সাপোর্ট আছে। এই মানসিক অবসাদের যেই বেড়া তা অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রী ভাংতে পারে। সংখ্যায় কম বিধায় তারা সপ্তাহে ১-২ জনকে এভাবে পিটাতে দেখেও তাদের বলার সুযোগ ছিল না, আর যাদের কিছুটা বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো তারা নানাবিধ কারণে জেগে ওঠার আগেই স্তমিত হয়ে যেত।

তাই অামার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এই আপদ দূর করার উপায় হলো মেধাবীদের রাজনীতি সচেতন করে তুলতে হবে। ভালো মন্দ বুঝার মত মনন সৃষ্টি করতে হবে। পুস্তকের জ্ঞানের পাশাপাশি মননের জ্ঞান আহরণ করতে হবে। যখন একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী নেতৃত্বে আসবে, তখন ঐ না জানা ইতর রাজনৈতিক দর্শন জানালা দিয়ে পালাবে।

শিক্ষকদের আরও অনেক বেশি সহনশীল হতে হবে, কোন ছাত্র-ছাত্রী আন্দোলনে গেলেই সে বখে যায় না, এটা অনুধাবন করতে হবে। আমার মতাবলম্বি বলেই তার জন্য সুপারিশ করতে হবে, আর না হলেই তার পদেপদে কন্টক দিয়ে রাস্তা বন্ধ করতে হবে, এই চিন্তা ধারা থেকে বের হয়ে অাসতে হবে। শিক্ষকদের এটা অনুধাবন করতে হবে, শুধু পুস্তকের শিক্ষাই আসল শিক্ষা না, মননশীলতার, মানবিক শিক্ষাই আসল শিক্ষা। ভালো কাজে সাহস দিতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে, সেটা কঠিন পথ হলে কাঁধে কাঁধ রাখতে হবে।

শিক্ষকদের পাশাপাশি পরিবার, সমাজকেও একই ধারণা ধারণ করতে হবে। ভালো কাজে পাশে থাকতে হবে, মানসিক বিকাশের জন্য, মননের বিকাশের জন্য। তাদেরকে বুঝাতে হবে, নিজের জন্য না অন্যের জন্য বাঁচো। যেই বাঁচায় আনন্দ আছে, অন্যের ভালোবাসা আছে।



লিখেছেনঃ সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষাছুটি), ইটিই বিভাগ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।