গবেষণা ও মান সম্মত উচ্চ শিক্ষায় দেশের রোল মডেল: বিইউপি

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


বাংলাদেশের শিক্ষা, গবেষণা ও সামরিক বিদ্যাকে আরও এগিয়ে নিতে ২৯তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ২০০৮ সালের ৫ জুন যাত্রা শুরু করে। ঢাকার মিরপুর সেনানিবাসে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রয়েছে। নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন’ ব্রত নিয়ে বিইউপিতে শিক্ষা-গবেষণা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

করোনাকালীন সময়ে বিইউপি শিক্ষার্থীদের পর পর ২টি সেমিস্টারের ফাইনালসহ সকল পরীক্ষা সমাপ্তের পথে যা দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক। সাম্প্রতিককালে, বিইউপি লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সফটওয়ার তাদের ওয়েবসাইটে সংযুক্ত করেছে যার ফলে তারা ভবিষ্যতে যে কোন সংকটের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য কাজে লাগাতে পারবে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যে সেন্টার ফর হায়ার স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের (সিএইচএসএস) মাধ্যমে এখানে এমফিল, পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। দেশি গবেষকদের পাশাপাশি বিদেশি গবেষকরাও এখানে গবেষণা করছেন।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনদর্শন, মতাদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণার জন্য বঙ্গবন্ধু চেয়ার নামে গবেষণাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে গবেষণা খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যয় তালিকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ৯ম স্থানে ছিল যার ব্যয়ের পরিমাণ ছিল এক কোটি ছয় লাখ টাকা।

এ বিষয়ে পিএইচডি গবেষক আদিবা আনিস বলেন, “উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতই গবেষণা শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করে বিইউপি। এখানে সকল প্রয়োজনীয় উপকরণের যথোপযুক্ত সমন্বয়ে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে যে পাঠদান প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় তা প্রশংসনীয় এবং শিক্ষক হিসেবে যারা নিয়োগ পান, তাঁরা একাধারে অনন্য ও নিজ গুণে প্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিষ্ঠানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করতে পেরে আমি গর্বিত”।

লেখকের আরও কলাম পড়ুন

তারুণ্যের ভাবনা: বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ

বিচারহীনতার সংস্কৃতি: ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও আমরা

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- এখানে সাধারণ ও বেসামরিক পরিবারগুলোর মেধাবী শিক্ষার্থীরাও মানসম্পন্ন, উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বিইউপি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিজস্ব গুণগত মান ধরে রেখে খুব দ্রুত শিক্ষাকার্যক্রমের প্রসার ঘটিয়ে চলেছে। এর অধীনে এখন সশস্ত্র বাহিনীর ৫৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচটি অনুষদের মাধ্যমে ১৬টি বিষয়ে অনার্স ও ৯টি বিষয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা কার্যক্রমকে আরও উন্নত করার জন্য বিইউপি রূপকল্প- ২০৩০ প্রণয়ন করা হয়েছে।

তিন পর্যায়ে এটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম করা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়টি ২০১৬-২০২০ সাল, দ্বিতীয় পর্যায় ২০২১-২০২৫ সাল ও সর্বশেষ পর্যায় ২০২৬-২০৩০ সালে শেষ হবে। এই কার্যক্রম সম্পন্ন হলে বিইউপির ২৩টি বিভাগের অধীনে মোট ১২ হাজার ৯০০ জন দেশ-বিদেশের ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা, গবেষণার সুযোগ পাবে। রূপকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির জনবল বাড়ানোর বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

BUP JOURNAL’ নামে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের নিজস্ব গবেষণা জার্নাল আছে। এ নামেই জার্নালটি আইএসএসএন (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড সিরিয়াল নম্বরে)তালিকাভুক্ত রয়েছে। সারা বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা ধরনের খেলার আয়োজন থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ব্যাচ, বিভাগ, সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, ভলিবল খেলার আয়োজন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের (সিএমএল) সেন্টারের অধীনে ফরাসি, আরবি, রাশিয়ান, জার্মান, জাপানিজ, ইংরেজি, বার্মিজ, টার্কিশ ও চীনা ভাষা শিক্ষা কোর্স আছে। বিইউপির সব প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম ভালো ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে অনেক সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে অনলাইন অ্যাডমিশন সিস্টেমে অনলাইন ফরম পূরণ, রেজিস্ট্রেশন, প্রবেশপত্র প্রদান, ভর্তি ব্যবস্থাপনা, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফলাফল প্রস্তুত করাসহ নানা কাজ করা হয়।

বিইউপির সব যানবাহন ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে সরকারি বা ব্যক্তিগত কাজের গাড়ি ব্যবহারের আগে ব্যবহারকারীরা ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের গাড়ির চাহিদা প্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হিসাব সংরক্ষণ ও পেমেন্ট অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড পেরোল সিস্টেমে সম্পন্ন করা হয়। বিইউপি বিষয়টিকে আমাদের উচ্চশিক্ষার অন্যতম দুর্বল দিক হিসেবে বিবেচনা করে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেজেন্টেশন ও কারিকুলাম স্কিলের ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে এবং অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের মেধাগত চর্চা বাড়াতে, সবার মেধার বিকাশ ঘটাতে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস বিইউপি)-তে অনেক বৃত্তি ও ভাতা আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রধান কর্তৃক প্রবর্তিত বৃত্তি ছাড়াও বিউপির নিজস্ব বৃত্তি ও ভাতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহশিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য ২১টি ক্লাব রয়েছে। প্রতি বছর এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। একাডেমিক উন্নয়ন বিষয়ে বিইউপির বিবিএ ফাইনাল ইয়ারের শিক্ষার্থী মো. নাফিজুর রহমান বলেন, “আমাদের আন্ডার-গ্রাজুয়েটের কোর্সগুলো থিউরির পাশাপাশি প্রাকটিক্যাল থাকলে আরও প্রয়োগিক ও বাস্তবিক হবে।”

শ্রেণিকক্ষ, শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষাদান কৌশলগুলোর মানোন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষককে নিজ নিজ ফ্যাকাল্টি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। তাঁদের শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সে খরচ বিশ্ববিদ্যালয় বহন করে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি হিসেবে প্রকাশের পর প্রার্থীদের শিক্ষা ও সহশিক্ষা যোগ্যতা বিবেচনা করে শর্টলিস্ট করা হয়। তাদের লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পর প্রেজেন্টেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্কিল যাচাই-বাছাই শেষে প্রতিটি পদের বিপরীতে অন্তত তিনজন প্রার্থীকে উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

আমার জানা মতে, বাংলাদেশের অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এত নিবিড়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় না। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভের পর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নবনিযুক্ত শিক্ষককে সরাসরি ক্লাস নেওয়ার জন্য না পাঠিয়ে অফিস অব দি ইভ্যালুয়েশন, ফ্যাকাল্টি অব কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বাবধানে ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এর পর ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সুতরাং দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গবেষণা, মান সম্মত শিক্ষা, শিক্ষক নিয়োগসহ সকল ক্ষেত্রে বিইউপি হতে পারে রোল মডেল।

লেখক: পিএইচডি গবেষক ।