আইনের শাসন থাকতেও এ কেমন বর্বরতা!

আইনের শাসন থাকতেও এ কেমন বর্বরতা!

জিসান তাসফিক


সম্প্রতি খবরের পাতায় কিংবা ফেসবুকে চোখ দিলে দেখা যায় ধর্ষণ, গনধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা, অর্থ পাচার ইত্যাদি বিষয় বস্তু নিয়ে দেশে তোলপাড়। দেশের আপামর জনগণের দাবি থাকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার। কিন্তু এই সব জনগণের মধ্যে হতে অপরাধী হয় এবং অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। আবার অপরাধীদের পার করার জন্য জনগণের মধ্যেই থেকে সাহায্যকারী বের হয়ে আসে।

অপরাধ যেই করে এবং যেই সাহায্য করে উভয় আইনের চোখে সমান অপরাধী। সমাজবিশেষজ্ঞদের মতে প্রাচীনকালে আইনের যথাযথ শাসন ছিল না বলে বর্বরতা ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে যেটাকে আধুনিক বলা হয়, সে যুগে বর্বরতা সম্মুখীন হওয়া কোনো মানুষের কাম্য হতে পারে না।

মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলতে উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ বোঝান হয়। বর্বরতা এর পূর্বেও ছিল কিন্তু ঐতিহাসিকগন এই সময়কে নিয়ে আলোচনা করেন। এই সময়কালে সমাজে, রাষ্ট্রে অনেক বর্বরতার ইতিহাস দেখা যায়। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী যখন জন্মগ্রহণ করেন তখনকার সময়কে বলা হত আইয়ামে জাহেলিয়া অর্থাৎ অন্ধকার যুগ। এসময় কোনো আইন ও ন্যায়বিচার ছিল না। গোত্রে গোত্রে ছিল দ্বন্দ্ব।

নারী ও শিশুরা ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত। এমনও প্রথা ছিল যে নারীদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত। কিন্তু নবীজির প্রচেষ্টায় সেখান থেকে মানুষ সভ্য হতে থাকে ও মানুষের মধ্য মনুষ্যত্ব আসতে থাকে। শুরু হয় নতুন ধারা শাসনব্যবস্থা যার অন্যতম সাক্ষী হল মদিনা সনদ, কুরআন ও হাদিস। মদিনা সনদে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে এবং অসহায় ও দুর্বলদের সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।

অন্যদিক ইউরোপ তখন উন্নত ছিল না। ত‍ৎকালিন সময়ে গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছিল না যার বলে শাসক শ্রেণীর আদেশই ছিল আইন । ১২১৫ সালে ম্যাগনাকার্টা চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে সাংবিধানিক শাসনের সূচনা হয়। এর পরে ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে ব্রিটেনে গনতন্ত্র শক্তিশালী ভাবে শুরু হয়। কিন্তু আইনের শাসন দীর্ঘদিনের ফল। এর পরে আশা যায় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে এই উপমহাদেশে রাজতন্ত্র উঠে যায় এবং আসে ব্রিটিশ শাসন। উপমহাদেশের যতগুলো লিখিত আইন আসে তার বেশির ভাগই ব্রিটিশদের হাতে গড়া।

কিন্তু এই সকল বিপ্লবে মানুষের অনেক কিছুই দিতে হয়েছে। ইতিহাস দেখলে জানান যায় যে ব্রিটিশরাও আইনের শাসন চালু করলেও তাদের শোষণ ও অত্যাচার থেকে ভারতীয়গন মুক্ত ছিল না। মানুষ যখনই তাদের নায্য দাবির আশায় বিপ্লব করেছে তখনই শাষক শ্রেণী দমননীতির মাধ্যমে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর থেকে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন দুইলক্ষ মা-বোন নিজের সম্ভ্রমহানি হয় । কিন্তু এর কোনো বিচার হয় নি। পরাজিত সৈনিকেরা ব্যারাকে ফিরে গিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাবিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন, নির্যাতন ও ধর্ষণ হয়েছে। উভয় পক্ষের লোকজন ধর্ষণে জরিত থাকলেও বিচার হয় নাই।

যুদ্ধ জয়ের জন্য ধর্ষণ কোন যুক্তিতে প্রয়োজন তা আজও জানলাম না। আরব অঞ্চলে এখনও অনেক যুদ্ধ বিগ্রহ হয়। এখনও সেখানে নারীরা ধর্ষিত হয়। মানুষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে আধুনিক হলেও মনুষ্যত্বতে আধুনিক হতে পারে নি। জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী নারী ও শিশু এবং যুদ্ধ বন্দীদের উপর অত্যাচার করা যাবে না কিন্তু বাস্তবতা আমরা সবাই জানি। আমাদের পার্শবর্তী দেশের মায়ানমার সেনাবাহিনীর ধর্ষণ নির্যাতনের কথা আমরা অবগত। কিন্তু সেই ঘটনা কোনো বিচার এখনো হয় নি। অথচ বিশ্ব নেতারা দাবি করে আসছে পৃথিবী উন্নত হচ্ছে।

দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার সেই প্রাচীনকাল থেকে এসেছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ, সতীদাহ প্রথা রদ , বিধবা বিবাহ ইত্যাদি না হলে ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য নারীরা আজও নির্যাতিত হত। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু নির্যাতনের শিকার হলে বাচার আশাও শেষ হয়ে যায়।

আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও সাংবিধানিক আইনত ভাবে সকল মানুষকে সমান সুযোগ, সুবিধা ও অধিকার দিয়েছে । নারী নির্যাতনের মাত্রা প্রতিহিত করার লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর জন্য প্রতিটি জেলা আলাদা ট্রাইব্যুনাল ও আছে। কিন্তু এরপরে ধর্ষণ কমানো যাচ্ছে না। এরপরেও আছে বিচারকের সংকট। বিচার বিভাগে প্রায় ৩৫ লক্ষাধিক মামলার জট রয়েছে। সেখানে বিচারক আছেন ১৮০০ এর মত। এত অল্প সংখ্যক বিচারক দিয়ে এত মামলা নিষ্পত্তি এবং ন্যায়বিচার আশা করা কল্পনার মত। একজন বিজ্ঞ বিচারক বলেছেন ১৮ কোটি মানুষের জন্য কমপক্ষে প্রয়োজন ১৮ হাজার বিচারক। বিশেষ মামলার ক্ষেত্রে দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আজ সেখানেও মামলার জট পরে আছে।

এছাড়াও বাংলাদেশের বিচার বিভাগের নিজেস্ব কোনো অডিট সেল নেই। যার কারণে মামলার রায় অনুযায়ী বাস্তবায়ন নিয়ে আদালতে কোনো পর্যালোচনা করতে পারে না। ভুক্তভোগীদের সর্বোচ্চ আইনত সুবিধা হল রিট করা। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে রিট করাতো দূরে থাকে রিট সম্পর্কে কোনো ধারণাও নেই।

এছাড়াও কিছু বিশেষ ব্যক্তি আইনের সৌন্দর্যের অপব্যবহার করে আসামীদের পার করে দিচ্ছে অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ নিয়ে থাকে। একদিকে মামলার জট অন্য দিকে আইনের অপব্যবহার। যার ফলে দিনে দিনে ধর্ষণ, নির্যাতনের মত নিকৃষ্ট অপরাধ বেড়েই চলেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে ২০২০ সালে এখন পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এগুলো প্রকাশিত ঘটনা।

কিন্তু এমন ঘটনা অনেক অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ঘটনাটি ঘটার ৩২ দিন পরে প্রকাশিত হয় তাও আবার ভিডিও নিজেরা প্রকাশ করে তার মাধ্যমে তা না হলে অপ্রকাশিতই থেকে যেত। স্থানীয় লোকজন, স্থানীয় সরকার প্রশাসন অথবা মাঠ প্রশাসন সবাই নিশ্চুপ ছিল যেখানে ধর্ষণের মত ঘটনা জনগণ মেনে নিতে পারে না ।

দেশের এমন পরিস্থিতিতে সরকার জনগণকে পাশে নিয়ে এইসব মোকাবেলা করা সম্ভব। আইনের সুশাসন বাস্তবায়ন করে প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে সবাইকে শেখা উচিত নয়তো অবহেলার কারণে জনগণের মধ্যে বিপ্লব এসে যাবে।

লেখকঃ জিসান তাসফিক
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *