এই দেশে যেন বিজ্ঞানী না জন্মে!

এই দেশে যেন বিজ্ঞানী না জন্মে!

শাফিউল কায়েস


বাংলাদেশে যেন বিজ্ঞানী না জন্মে! আমারা  বাঙালি হিসেবে অন্য জাতির তুলনায় নিঃসন্দেহে সাহসী। সাহসীকতার প্রমাণ এর আগে আমরা দিয়েছি। তবে নতুন আরেকটি গুণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হয়েছে। সেটি হচ্ছে তেলবাজি।  তেল মেরে কথা বলাটা এখন অনেকের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

আমরা এখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত অর্থাৎ আত্নকেন্দ্রীক হয়ে গেছি। সমাজ কিংবা দেশের কথা আমরা ভাবী না।  যাঁরা ভাবেন তাদের পা টেনে ধরে রাখা হয়েছে।  যাঁরা দেশের জন্য, জাতির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মূল্যায়ন করতেছি না। যাঁরা সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে সম্মান না করে যারা সম্মান পাওয়ার অযোগ্য তাদেরকে আমাদের সম্মানের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে যাই।

অপ্রিয় হলেও সত্য- সম্মান পাওয়ার অযোগ্য ব্যক্তিদের যতই সম্মান দেখিয়ে ওপরে স্থান দেওয়া হোক তাদের মূল্য বা দাম দুই টাকার নোট। হাজার টাকার নোট নিচে থাকলেও তার মূল্য বা দাম আমাদের সবার জানা।

আমরা বিদেশি পণ্যে বিশ্বাসী।  দাম বেশি হোক বিদেশি পণ্য চাই।  আমরা দেশকে নিয়ে ভাবলে হয়তো দেশি পণ্য কিনতাম।  দেশি পণ্য হতো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একমাত্র ভালোবাসা। এতে করে দেশের অর্থনীতির চাকার গতি বেড়ে যেতো।

এবার আসি আমাদের বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল  স্যারের প্রসঙ্গে। সম্প্রতি অক্সফোর্ডের অধ্যাপক সারা গিলবার্টের ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনের চেয়ে আমাদের বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট এ মুহূর্তে মানবজাতির জন্য কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সারা গিলবার্ট ভাইরাল হলেও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানী বিজনদের মত বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার।

বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল বাংলাদেশে জন্মেছেন, এজন্য তিনি আমাদের কাছে মূল্যহীন?  ড. বিজন কুমার শীল সার্সের কুইক টেস্টের আবিষ্কারক।  তিনি বাংলাদেশি অণুজীববিজ্ঞানী। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের প্রধান বিজ্ঞানী।

তাঁর নেতৃত্বে করোনা ভাইরাস সনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার

সাল ২০০৩। সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তখন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সার্সের কুইক টেস্ট পদ্ধতি আবিষ্কার ছিলো করোনা ভাইরাস এর পূর্বসূরী।

‘র‌্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটি ড. বিজন কুমার শীলের নামে পেটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং সফলভাবে সার্স মোকাবেলা করে।’ তারপর তিনি সিঙ্গাপুরেই গবেষণা করছিলেন ডেঙ্গুর ওপরে। গবেষণা চলাকালে তিনি দুই বছর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দেন।

করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ‘GR COVID-19 Dot Blot’ কিট তৈরির জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষকদের দলটি কাজ করছে ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে। বাকি গবেষকরা হলেন—ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন, ড. ফিরোজ আহমেদ।

রবিবার (২৬ এপ্রিল) রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের এক সংবাদ সম্মেলনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ গ্রহণে অনিহা দেখিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের ঔষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের বুঝতে হবে, কিভাবে তারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে রক্ষা করছেন। গত ৪৮ বছরে গণস্বাস্থ্য কাউকে ঘুষ দেয়নি, দেবে না। গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিট (ব্যবহারযোগ্য হয়ে) আসুক আর না আসুক, কাউকে ঘুষ দেব না। কিন্তু লড়াই করে যাব।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে ঠিকই বলেছেন। যদি ঘুষ দেওয়া হতো ঠিকিই গণস্বাস্থ্যের করোনার পরীক্ষার কীট গ্রহণ করতো। স্যালুট আপনাকে জাফরুল্লাহ স্যার। আপনি লড়াই করে যান। সাধারণ দেশের নাগরিক আপনাদের আবিষ্কার, অবদান ভুলবে না। আপনাদের জন্য একবুক ভালোবাসা।

জন্ম বিজ্ঞানীর কৃষক পরিবারে

বিজ্ঞানী বিজন কুমার ছিলেন কৃষক পরিবারের ছেলে। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় ১৯৬১ সালে জন্ম  নেন। তিনি দীর্ঘদিন বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করেছেন। বাবা রসিক চন্দ্র শীল ও মা কিরণময়ী শীলের ২ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম বিজন। শুরু

তিনি বনপাড়ার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ হয়ে ভর্তি হন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে স্নাতক হন ভেটেরিনারি সায়েন্স বিষয়ে। ফলাফল ছিল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন অণুজীববিজ্ঞানে।

এরপর তিনি কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে দ্য ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৯২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে (ডেভেলপমেন্ট অব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ)। সেই থেকে অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীলের অণুজীববিজ্ঞান বিশেষ করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর গবেষণা আর থেমে থাকেনি।

বিজন কুমার শীলের নামে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে । পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় জার্নালগুলোতে ২০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীলের স্ত্রী অপর্ণা রায় একজন প্রাণী চিকিৎসক। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

আবিষ্কার, অর্জন এবং অবদান

অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে বিজন কুমার শীলের নামে। তিনি ৯০-এর দশকে ব্ল্যাকবেঙ্গল প্রজাতির ছাগলের সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন। তিনি ২০০২ সালে ডেঙ্গুর কুইক টেস্ট পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ২০০৩ সালে তিনি সার্সের কুইক টেস্ট পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যা করোনা ভাইরাস এর পূর্বসূরী। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সার্স প্রতিরোধে যে ক’জন বড় ভূমিকা রেখেছেন, ড. বিজন শীল তাদের একজন। সার্স প্রতিরোধ তিনি সিঙ্গাপুর সরকারের বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৯ সালে ছাগলের মড়ক ঠেকানোর জন্য তিনি পিপিআর এবং আফলাহ টক্সিন এর প্রতিষেধকও দেশীয় পদ্ধতিতে আবিষ্কার করে প্রান্তিক খামারীদের আশার মুখ দেখিয়েছেন।

আমাদের সকলে উচিত আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের মূল্যবান আবিষ্কার গ্রহণ করা। তাঁদেরকে মাথায় তলে রাখা। আমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের অহংকার।  দেশের বিজ্ঞানীরা যথাযথ সম্মান যেন পায়। আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের কদর করলে দেশে হাজার হাজার বিজ্ঞানী তৈরি হবে।  দেশটা আরো একশ ধাপ এগিয়ে যাবে। যদি ড. বিজন কুমারদের মত বিজ্ঞানীরা যদি যথাযথ সম্মান না পায়, তাহলে বলবো হে আল্লাহ, বাংলাদেশে আর যেন কোন গবেষক বা বিজ্ঞানী না জন্মে।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া।


লেখক: শিক্ষার্থী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *