কালো মেয়ের বিয়ে

কালো মেয়ের বিয়ে

লায়লা লিজা


নিরা! কুচকুচে ঘনকালো তার চুল। বড় বড় দুটি চোখে কাজল পরলে সবাই ঘুরে তাকাতে বাধ্য। তাকে আজ দেখতে এসেছে ছেলে পক্ষ!

ছেলে ভালো একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। ভালো বেতন পায়। নিরার বয়স কম। মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দিতে হবে কেনো নিরা বোঝেনা।তারপরও চাচার কথামত নিরা শাড়ি পরে। মায়ের কথামত ফর্সা হওয়ার ক্রিমটা মাখে। সে আবার কালো কিনা!

জীবনের প্রথমবার এতকিছু পরে নিরার নিজেকে ক্লাউন মনে হচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। সামান্য হিল জুতা পাল্টে নিচু জুতা পরতে চাওয়ায় বাবার কাছে রাম ধমক খেয়েছে নিরা। নিরা বোঝে না দুই ইঞ্চি লম্বার জন্য এমন কি হবে? তখনও নিরা জানে না দুই ইঞ্চি কেনো হাফ ইঞ্চি কম থাকাও বিয়ের ক্ষেত্রে মহাপাপ।

নিরা প্রায় দুই ঘন্টা ধরে বসে আছে। ছেলেপক্ষের আসার কথা অনেক আগেই। তারা আসতে দেরি করে আর নিরাকে এই ফাঁকে শেখানো হয় ছেলেপক্ষ আসলে কি কি করতে হবে তাদের সামনে। যেমন মাথায় কাপড় নিচে পরতে দেয়া যাবেনা, সুন্দর করে হাঁটতে হবে। আর ঘরে ঢোকার মুখেই উঁচু গলায় সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিতে হবে।

সবই নিরা মেনে নিয়েছে কিন্তু দুইটা ব্যাপারে নিরার অনেক লজ্জা লাগছে। একটা হচ্ছে তাকে লাল জামদানি পড়ানো হয়েছে আরেকটা হচ্ছে এই সালাম দেবার ব্যাপারটা। আস্তে সালাম দিলে কি সমস্যা নিরা বোঝেনা।

আরো ১ ঘন্টা পর ছেলেপক্ষ আসে। এতসময় ধরে নিরা কিছুই খেতে পারেনি লিপস্টিক নষ্ট হবে বলে। অতঃপর নিরার যাত্রা। নিরা সবার বলার পরেও জোরে সালাম দিতে পারেনা। আস্তে করে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকে। আড়চোখে দেখতে পায় কেও একজন ফিক করে হেসে ফেলেছে তাকে দেখে। নিরার মন খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। খুব অল্প কথাই বলে ছেলেপক্ষ। খাওয়ার দিকেই নজর তাদের। নিরার মা সকাল থেকে অনেক খাবার আইটেম বানিয়েছে তাদের জন্য। নিরা একপলক দেখে ছেলেকে।

এলোমেলো চুল, পড়নের শার্টও কুচকানো, আয়রন করা নেই। যেনো আসা দরকার বলেই আসা। নিরার সন্দেহ হতে লাগল ছেলেটাকে বোধহয় ঘুম থেকে তুলে আনা হয়েছে। একসময় নিরাকে যেতে বলা হয়। নিরা বের হয়ে আসে। সবাই ভীড় করে ধরে নিরাকে কি কি হল জানার জন্য। নিরা জানায়। শেষে নিজে একটা মন্তব্য করে ছেলেটা একটুও গুছিয়ে আসেনি।

নিরার ভাবি তখন বলে, ” সোনার চামচ বাঁকা হলেও সোনা।” নিরার এবারও মন খারাপ হয়। তাহলে তাকে এত সাজানো হল কেনো?

দিন যায়। ছেলেপক্ষ থেকে খবর আসেনা। নিরাসহ সবাই জানে কি হয়েছে কেও কথা বলেনা। একদিন মার ঘরে যাওয়ার সময় নিরা শুনে ফেলে ভাবি বলছেন,” নিরা তো কালো এজন্য ওদের পছন্দ হয়নি।”

নিরা আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজেকে অভিশাপ দিতে গিয়েও দেয়না। ভাবে ছেলেটাও তো কালো ছিল, দাঁতের মাঝখানে ফাক ছিল। নিরারা কি ওদের কিছু বলেছে?

এরপর নিরা ব্যাগ গুছায়। তাকে ফিরতে হবে ঢাকায়। পড়াশুনা করতে হবে। অনেক বড় হবে নিরার। তার যোগ্যতার কাছে কোনো ছেলে যাতে কালো না বলতে পারে সেই উদ্যোগ নেয় নিরা। দুই বছর কেটে যায়। বড় বড় ছুটি ছাড়া নিরা বাড়ি আসেনা। পড়াশুনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। বয়স হলে বিয়ে হবেনা এমন কথা শুনেও না শোনার ভান করে।

ঢাকা ভার্সিটিতেও চান্স পায় নিরা। মা একদিকে খুশি আরেক দিকে বেজার। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে তো। নিরা অনেকের বিয়ের কথা শুনে। তাকে দেখতে আসা ছেলেটা নাকি টেনে পড়া এক মেয়েকে বিয়ে করেছিল ওই বছরই। তাদের এখন দুইটা বাচ্চা।মেয়েটা আর পড়ার সুযোগ পায়নি। অথচ এস.এস.সি তে গোল্ডেন এ+ পেয়েছিল মেয়েটা।

এই প্রথম নিরা নিজের গায়ের রংকে বাহবা জানায়। আর মেয়েটার জন্যও কষ্ট হয়। আহা কি সুন্দর ফর্সা আর সুন্দর ছিল মেয়েটা। এখন ওজন বেড়ে আর চেনাই যায় না। নিরা আগের মতই আছে। কালো একহারা গড়ন। চোখে কাজল পড়লে ভালই লাগে!

নিরা বি.সি.এস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে।এর ভিতরে পার হয়ে গেছে অনেক বছর। নিরার বাবা মারা গেছে। মাকে নিয়ে নিরা থাকে। আজ নিরার সব আছে, সবাই তাকে ম্যাডাম বলে ডাকে। কত জায়গায় কত সম্মান তার।

তারপরও নিরার মা আফসোস করে বলে,”ইস! মেয়েটা কালো বলে একটা ভালো বিয়েও হল না!

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *