মানব কল্যাণে জিনোম এডিটিং: কৃষি থেকে স্বাস্থ্য সেবা পর্যন্ত
গাজীপুরঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) কর্তৃক “মানব কল্যাণে জিনোম এডিটিং: কৃষি থেকে স্বাস্থ্য সেবা পর্যন্ত” শিরোনাম শীর্ষক একদিনের সেমিনারের আয়োজন হয়।
সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ এর ফুলব্রাইট স্কলার ও বিজ্ঞানী এবং জিনোম এডিটিং’র বিশেষজ্ঞ ড. কুতুবউদ্দিন মোল্লা। জিনোম এডিটিং গবেষণায় তিনি একজন বিশ্ব নন্দিন তরুণ বিজ্ঞানী। তিনি বর্তমানে প্ল্যান্ট সেল জার্নালের সহকারী বৈশিষ্ট্য সম্পাদক হিসাবে কাজ করছেন তিনি সুনির্দিষ্ট জিনোম ইডিটিং করতে আগ্রহী এবং ফসলের উন্নতির জন্য ক্রিসপার কাস এবং অন্যান্য উন্নত ইডিটিং কৌশল ব্যবহার করেন। এনআরআরআই-তে তার ল্যাব অভিনব জিনোম ইডিটিং সরঞ্জাম তৈরি করেছেন এবং সেটির সুব্যবহার করে চলেছেন।
তিনি কৃষি উৎপাদনে এবং স্বাস্থ্যসেবায় জিনোম এডিটিং এর ব্যবহার ও সফলতা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। আলোচনার সুচি ছিল ১)ক্রপ ডোমেস্টিকেশন ২)জিনোম ইডিটিং টুলস ৩)এগ্রিকালচারাল হারভেস্ট ইন ফিল্ড এবং ৪)হেলদকেয়ার ল্যাব টু ক্লিনিক। ন্যাচারাল মিউটেশন, কৃত্রিম সেলেক্টশন, জেনেটিক ভেরিয়েশন, ক্রপ ইমপ্রুভমেন্ট, মোবাইল ক্রিস্পার কাস মেথড, প্রাইম ইডিটিং, গাইড আরএনএ, ক্যামিকেল ব্রিডিং, ইত্যাদি বিষয়ে সর্বশেষ আপডেট তথ্য প্রদান করেন। বিগত ২০ শতাব্দী পর্যন্ত, নিঃস্বার্থ জিনগত পরিবর্তন ছিল একমাত্র উৎস যেখান থেকে মানব জাতি গৃহপালিতকরণ ও প্রজননের জন্য উপযোগী উদ্ভিদ ও প্রাণী নির্বাচনে নতুন জিনগত বৈচিত্র্যের সদ্ব্যবহার করতে পারত। উদ্ভিদ প্রজননে বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয় যখন আয়নিকরণ বিকিরণের মাধ্যমে জীবের জিনগত গঠন পরিবর্তন করা যায় বলে প্রমান পাওয়া যায়। ড. মোল্লা জিনোম এডিটিং এর বিভিন্ন পদ্ধতি, দুর্বলতা এবং ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ স্বাস্থ্য সেবার লক্ষ্যে আধুনিক ও যুগোপযোগী আরো অত্যাধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
তিনি বলেন জিনোম এডিটিং, জিন থেরাপি বা জিন প্রযুক্তি নামেও পরিচিত, জীবন্ত কোষের ডিএনএ পরিবর্তন করার একটি ক্ষমতাধর পদ্ধতি। এটি বিজ্ঞানীদের নির্দিষ্ট জিনগুলিকে সংশোধন করতে, মুছে ফেলতে অথবা নতুন জিন যোগ করতে দেয়। ফসলকে ভাইরাস, ছত্রাক, পোকামাকড় এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষা, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, কীটনাশকের ব্যবহার কম, এইসব কিছুই জিনোম ইডিটিং (ক্রিস্পার কাস) ব্যবহার করে করা হয়।
জিনোম এডিটিং ব্যবহার করে সিস্টিক ফাইব্রোসিস, হান্টিংটন’স ডিজিজ এবং থ্যালাসেমিয়া সহ বিভিন্ন জিনগত রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব ভারত বা বাংলাদেশেই। ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করে এমন নতুন থেরাপি তৈরি করা যায় যা ক্যান্সার নির্মুল এ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। HIV, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মার মতো সংক্রামক রোগের সহজ সাবলীল সমাধান জিনোম ইডিটিং। তিনি একাধিক উদাহরণ দিয়ে জিনোম এডিটিং এর প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা এবং এর প্রভাবগুলি ব্যাখ্যা করেন এবং জেনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) এবং জিনোম এডিটেড ফসলের পার্থক্য, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, মেধাস্বত্ব এবং ভবিষ্যতের গবেষণার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। লেকচার শেষে মুগ্ধ অংশগ্রণকারীদের সাথে একটি চমৎকার মিথস্ক্রিয়াপূর্ণ সেশন বিষয়টি আরো গভীরভাবে জানতে বিশেষভাবে সহায়ক ছিল।
সেমিনারের মুল আলোচক হিসেবে আইবিজিই’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর তোফাজ্জল ইসলাম বলেন জিনোম এডিটিং শুধুমাত্র কৃষি ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেনি বরং রোগ নির্ণয় ও বিশ্বব্যাপী গবেষণার নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তিনি বাংলাদেশকেও এই আধুনিক গবেষণার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে বলে মনে করেন। সেই সাথে বাংলায় লিখিত তার বাংলাদেশের প্রথম বই “জিনোম ইডিটিং” সর্বস্তরের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পড়ার জন্য আহবান করেন। তিনি বিশ্বাস করেন এই বই পড়লে জিনোম ইডিটিং বাংলাদেশের মানুষের কাছে সহজ উপলুব্ধ ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম ড. কুতুবের প্রবন্ধ এবং উপস্থাপন শৈলির ভূয়সী প্রসংশা করেন এবং উপস্থিত সবাইকে আইবিজিই এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান। জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জলবায়ু স্মার্ট শস্যের জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিজ্ঞানীদের একযোগে কাজ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি ড. কুতুবকে তাঁর গবেষণাদলের সাথে সহযোগীতা আরো জোরদার করার আহবান জানান। সর্বশেষে তিনি ড. কুতুবকে মাতৃভাষা বাংলায় তার রচিত জিনোম এডিটিং বইটি উপহার দেন।
তিনি ড. কুতুবের সাথে গত ৬ বছর যাবত গবেষণা কোলাবোরেশনের সাফল্য এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা তুলে ধরেন। জিনোম এডিটিং ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ের তাদের উদ্ভাবিত কিটটি আফ্রিকা এশিয়া এবং বিশ্বব্যাপী প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তার কথা উল্লেখ করেন এবং অনুদানকারী সংস্থাকে ধন্যবাদ জানান।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন প্রধান অতিথি হিসেবে কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডক্টর আব্দুল বাসেত মিয়া; সম্মানীয় অতিথি হিসেবে আইবিজিইর পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর মাহবুবুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে অধ্যাপক ডঃ এ কে এম আমিনুল ইসলাম (জিপিবি); অধ্যাপক ডঃ মোঃ আহসানুল হক স্বপন(ইএনটি); অধ্যাপক ডঃ ফাতেমা খাতুন(ইএনটি); অধ্যাপক ডঃ মোঃ মোরশেদুর রহমান(ডিপিএস); অধ্যাপক ডঃ মোঃ মহিউদ্দিন (সিবিটি); অধ্যাপক ডঃ শাহ মোঃ নাইমুল ইসলাম (আইবিজিই); সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান হায়দার ইকবাল খান(সিবিটি); সহযোগী অধ্যাপক ডিপালি রানী গুপ্তা (আইবিজিই); সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান ডঃ নুরে আলম সিদ্দিকী (বিএমবি); সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান ডঃ আফসানা হোসাইন (পিএলপি) এবং সহকারী অধ্যাপক ডঃ আফজাল শেইখ(বিএমবি) উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষক, গবেষক , পিএইচডি, মাস্টার্স ও অনার্স শিক্ষার্থীসহ শতাধিক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক আব্দুল বাসেত মিয়া ড. কুতুবের বক্তব্যশৈলি এবং বিষয়ের গভীরতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন যুগান্তকারী জিনোম এডিটিং প্রযুক্তিটি কম্পিউটার এবং আইটির ন্যায় জীববিজ্ঞানীর সকল বিভাগেই অধ্যয়ন এবং গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবী। তিনি মনে করেন, জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি এবং জীবপ্রযুক্তির অগ্রসরমান বিষয় নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে আরও একটি কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী এবং তিনি ডিন হিসেবে কৃষি অনুষদে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন। অধ্যাপক তোফাজ্জলকে এ সেমিনার আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, যোগদানের পর থেকেই অধ্যাপক তোফাজ্জল বশেমুরকৃবিতে গবেষণা সংস্কৃতি উন্নয়ন এবং বিকাশে অসাধারন অবদান রেখে আসছেন। তাঁর গবেষণার আইডিয়া নতুন এবং যুগান্তকারী। গবেষণায় বশেমুরকৃবির অবদানের সিংহভাগই অধ্যাপক তোফাজ্জলের গবেষণা দলের। তাঁর স্বপ্নের ফসল আইবিজিই। গবেষণায় তিনি শুধু বশেমরকৃবির শিক্ষকদেরকেই অণুপ্রাণিত করেননি, নিজের দেশের জরুরী সমস্যা সমাধানে বিশ্বের নন্দিত বিজ্ঞানীদের একত্রিত করেছেন। তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য ড. তোফাজ্জল এক রোল মডেল। তিনি একজন ফ্রন্টিয়ার রিচার্সার। তাঁর সাথে আলোচনায় আমি সর্বদাই সমৃদ্ধ হই।
সেমিনার শেষে ডঃ মোল্লা আইবিজিইর ল্যাব ও গবেষণা কর্মকাণ্ড ঘুরে দেখেন এবং চলমান গবেষণার ভূয়সী প্রশংসা করেন ও আইবিজিই টিমকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি আইবিজিইর অত্যাধুনিক ল্যাবকে বিশ্বমানের এবং পৃথিবীর প্রথম সারির ল্যাবগুলোর একটি বলে মন্তব্য করেন।