মৎস্য সেক্টরে করোনার প্রভাব ও করণীয়

এস.এম.রফিকুজ্জামান


বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং বিগত কয়েক দশক ধরে মৎস্যচাষে অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে আজ বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এমতাবস্থায় হঠ্যাৎই করোনার প্রভাবে মৎস্য শিল্প রয়েছে চরম সংকটে।

২৬শে মার্চ, ২০২০ইং তারিখ হতে সরকারি ভাবে লকডাউন করার সাথে সাথে মৎস্য সেক্টরের সকল পর্যায়ের কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে। এ সেক্টরে করোনার প্রভাব নির্নয় কল্পে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টকহোল্ডারদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করে নিম্নোক্তভাবে এর প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয়।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস :

বিআইডিএস এর এক হিসাব অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। কর্মহীন মানুষের খাবার তালিকায় সুষম খাদ্যে তো দূরের কথা বাচাঁর ডাল-ভাত খাওয়াই মুশকিল হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, এ ধরনের কর্মহীন জনগোষ্ঠী মাছকে তাদের খাদ্যের তালিকায় রাখতে পারছে না। এছাড়াও রেস্টুরেন্ট, সামাজিক অনুষ্ঠান গুলো বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর কারণেও মাছ খাওয়ার সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

বহিঃদেশীয় ক্রয়াদেশ বাতিলকরণ :

বিশ্বব্যাপী করোনার পরিস্থিতিতে আমদানী রপ্তানী বাণিজ্য প্রায় বন্ধ আছে এবং পৃথিবীব্যাপী লকডাউন থাকার কারণে বিদেশী ক্রেতাগণ তাদের ক্রয়াদেশ ধারাবাহিকভাবে বাতিল করতেছে। ফলশ্রুতিতে বাজারে মাছের সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্রমশ মাছের দাম কমে যাচ্ছে। আমাদের বৈদেশিক আয়ের উল্লেখ্যযোগ্য উৎস চিংড়ী সেক্টরে খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়তেছে। একইভাবে স্বাধুপানির উৎসের মাছের রপ্তানীও উল্লেখ্যযোগ্য হ্রাস পাচ্ছে। সার্বিকভাবে ব্যাপক সম্ভাবনাময় মৎস্য সেক্টর প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়তে যাচ্ছে।

নিম্ন মূল্য:

কোভিড-১৯ এর লকডাউনের জন্য চাষকৃত মাছ এবং চিংড়ির দাম ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লকডাউন এবং স্থানীয় ক্রেতার অপর্যাপ্ততা বাজারকে অস্থিতিশীল ও মূল্যকে হ্রাস করছে।

পরিবহণ জটিলতা:

যোগাযোগ স্তব্ধ হওয়ার কারণে মৎস্য শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল,খাবার,ঔষধসহ অন্যান্য দ্রব্যের পরিবহণ জটিলতা দেখা যাচ্ছে। এমনকি মাছ আরোহনত্তোর বাজারে সরবরাহ এবং মাছের পোনা পরিবহণ সমস্যার কারণে গোটা মৎস্য শিল্প প্রায়ই থমকে গেছে।

গ্রীষ্মকালীন পোনা মজুদ সমস্যা :

এই সময়, পুকুরে মাছ মজুদ করার সঠিক সময় যা আগামী বছরের মাছ উৎপাদনকে নিশ্চিন্ত করবে। কিন্তু এ সময়টা বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বিভিন্ন কাঁচামাল তথা অ্যাকুয়ামেডিসিন,জীবাণুনাশক, শ্রমিক স্বল্পতা, মাছের পোনা ও খাদ্য ইত্যাদির অভাবে। অন্যদিকে মাছের দাম কম হওয়ায় মাছচাষীরা মাছ বিক্রি করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না।ফলে, গ্রীষ্মকালীন মাছ মজুদ করতে দেরী হচ্ছে।

কারিগরি পরামর্শের অভাব:

জাতীয় লকডাউনের জন্য মাছ চাষীরা অভিঙ্গ পরামর্শকদের নিকট হতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে চাষীরা সময়োপযোগী সমস্যার সমাধান পাচ্ছে না।
করণীয়-

অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিকরণ:

খবরের কাগজ,টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রোগপ্রতিরোধে মাছের প্রোটিনের বিভিন্ন উপকারী দিক সমূহ প্রচারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা বৃদ্ধি করা যায়। গ্রাম পর্যায়ে, ই-মার্কেট ও খোলা জায়গায় মাছের বাজার স্থাপনের মাধ্যমে মাছ ক্রয়-বিক্রয় সুনিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ মাছের চাহিদা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থা সহজীকরণ:

উৎপাদনকারী ও মাছের পাইকারদের জন্য একটি সমন্বিত ইলেকট্রিক পোর্টালের মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ের তথ্য সেবা কেন্দ্র ও উপজেলা ফিসারিজ অফিস যুগপৎ ভাবে সমন্বয় করতে পারে। এ সেবার মাধ্যমে উৎপাদক এবং ক্রেতার মধ্যে সহজেই সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব বলে মনে হয়।

শ্রমিকপ্রাপ্তির সহজলভ্যতা:

শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে তাদেরকে পুনরায় অ্যাকুয়াকালচারের বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিক প্রাপ্তির সহজলভ্য ও বিচরণ করানো সম্ভব। প্রয়োজনে ফার্মের মালিক শ্রমিক কার্ড সরবরাহ করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ সহজীকরণ:

সরকারি পর্যায় থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলাচলের অনুমিতপত্র প্রদান করা যেতে পারে। যার ফলে সাধারণ চাষী সহজেই বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারে। এক্ষেত্রে জেলা মৎস্য/ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মহোদয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করতে পারে।

কাঁচামালের সহজলভ্যতা:

অ্যাকুয়াকালচারের জন্য সকল ধরনের কাঁচামাল সরবরাহকারী অ্যাকুয়াফার্ম দোকানকে উন্মুক্ত রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে পরিবহণ সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক সহায়তা প্রদান :

অ্যাকুয়াকালচারের স্টেকহোল্ডারদের জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী সুদমুক্ত আর্থিক সহায়তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য যে, মৎস্য শিল্পের মধ্যে চিংড়ী খাত আমাদের দেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ সেক্টর এমনিতেই নানাবিধ সমস্যার কারণে চিংড়ী উৎপাদন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তাই আমি মনে করি, এ সেক্টরের সমস্যাকে সমাধানের জন্য বিশেষভাবে আর্থিক প্রণোদনা জরুরী।


লেখকঃ অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

কেমন আছে মতিহারের সবুজ চত্বর?

আনন্দ কুমার সাহা


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার, শিক্ষকদের সংখ্যা ১২০০’র অধিক, কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় ৭৫০, কর্মচারীর সংখ্যা ১৭০০’র অধিক। পরিবার-পরিজনসহ প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের সমাগম এই মতিহার ক্যাম্পাসে। কিন্তু বর্তমানে এই ক্যাম্পাস প্রাণহীন-মৃতপ্রায়।

তবু এর মধ্যেও বেশ কয়েকজন ক্যাম্পাস বাসিন্দা সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত প্যারিসরোডে হাঁটা-চলাফেরা করে থাকেন। তবে বেশী দেখামেলে পক্ষীকূলের। ফাঁকা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের পাখির দেখা মিলছে; যার মধ্যে শালিক-ঘুঘুর আধিক্য বেশী। সাদা বকগুলো বধ্যভূমি থেকে মধ্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত আহারের জন্য বিচরণ করছে। ঘুঘু পাখিগুলোকে স্বাভাবিক সময়ে রাস্তায় কিংবা প্যারিস রোডে এভাবে দেখা যেতো না। ঘুম থেকে উঠেই প্যারিস রোডে তাদের বিচরণ বেশ ভাল লাগে।

রাবি করোনা

ক্যাম্পাসে প্রায় ৫৬টি কুকুর বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করছে। কাজলা গেট দিয়ে প্রবেশ করে প্যারিসরোডে ৮-১০টি, কিছুদূর এগিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবনের সামনে ৪-৫টি, সিনেট এবং প্রশাসন ভবন এলাকায় ১০-১২টি, শহীদ মিনার, অডিটরিয়াম, বিনোদপুর গেট বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক কুকুরকে সন্ধ্যার দিকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। ছাত্র-কর্মচারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগিয়ে এসেছেন তাদের তদারকির জন্যে এটা দেখে খুব ভাল লাগে।

রাবি কুকুর

টিএসসিসি’র একজন কর্মচারী গাজীভাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলেই তিনি বাসা থেকে খিচুড়ি রান্না করে কুকুরদের খাওয়াতেন। এসময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি, প্রতিদিন টিএসসিসি-তে রান্না করে দুপুরে বিভিন্ন জায়গায় কুকুরদের খাবার পরিবেশন করেন তিনি। গাজী সাহেবের সঙ্গে যোগদান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

রাবি কুকুর খাবার

কৃষি প্রকল্পের পক্ষ থেকে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, মরিচ সরবরাহ করা হয় এবং গাজী সাহেবকে সাহায্য করার জন্য কৃষি প্রকল্প থেকে একজনকে তার সাথে কাজ করার জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবন থেকে মাঝে মাঝে রাতে কুকুরের খাবার দেয়া হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রসেনজিৎ এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে দুপুরে রাকসু ভবনের সামনে খিচুড়ি রান্না করে কুকুরদের সন্ধ্যায় খাবার সরবরাহ করে থাকে। এভাবেই ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তা এগিয়ে এসেছেন বিভিন্নভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য।

রাবি কুকুর খাবার

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ তহবিলে দান করেছেন ১ কোটি টাকা। উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার নেতৃত্বে রসায়ন বিভাগ প্রস্তুত করেছে স্যানিটাইজার। যা বিভিন্ন মহলে বিতরণ করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি দান করেছেন এক দিনের বেতন।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি এসেছিলো প্রচুর সংখ্যক। আশ্রয় নিয়েছিলো তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পিছনের পুকুরে এবং রোকেয়া হল সংলগ্ন পুকুরে। ইতোমধ্যে কচুরিপানায় ভরে গিয়েছে তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের পিছনের পুকুর, দেখা যাচ্ছে না অতিথি পাখিদের।

ক্যাম্পাসে আম-লিচু গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিলো। কিন্তু সে পরিমাণ আম ধরে নাই। অবশ্য যা আছে মোটামুটি তাও কম নয়। প্রশাসন ভবনের পাশের গাছগুলোর আমে যখন রোদের আলো পড়ে, খুব সুন্দর লাগে। হেঁটে যেতে মাথায় ঠেকে যায় আমগুলো। রবীন্দ্রভবনের সামনে টুকিটাকি সংলগ্ন ছোট্ট একটি গাছে আম ধরেছে, বেশ বড়ও হয়েছে, মাটি ছুঁই ছুঁই।

তাদেরকে বিরক্ত করছে না কেউ। যারা বিরক্ত করবে- তারাতো এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে। গত বছরে কোন এক সময় লিচুতে কেবল রং ধরেছে এক দিনেই অপরিপক্ক সে লিচুর অর্ধেক শেষ। এটা কি খাওয়ার জন্য সুস্বাদু ছিলো, না তাও নয়। বয়সের কারণে, বান্ধবীদের বীরত্ব দেখানোর জন্য লিচু পাড়া।

গত বছর রোকেয়া হলের পিছন থেকে আম পাড়াকে কেন্দ্র করে ভীষণ গণ্ডগোল। অবশেষে ১০টি গাছের লিচু, ২০টি গাছের আম পাকার পূর্বেই শেষ। দেখে মনে হয়েছিলো ধ্বংসযজ্ঞ, কালবৈশাখীর ঝড়ে লণ্ডভণ্ড। এবার এখনও কোন আমবাগানে পাহারাদার নেই, তবুও আমগুলো মাটি ছুঁই ছুঁই আমগাছের নিচে অজস্র ছোট ছোট আম পড়ে আছে। কুড়ানোর পরও গাছের নীচে বিছিয়ে আছে প্রচুর আম। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে আম ঝরে পড়ে যাচ্ছে।

আমগুলো বলছে- ‘আমার খেলার সাথীরা তোমরা কোথায়? বড্ড মিস্ করছি তোমাদের’।

রাবি আম গাছ

এরই মধ্যে দায়িত্বপালন করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রহরীরা, ফুলগাছগুলোতে পানি দিচ্ছে মালীরা। মধ্য ক্যাম্পাস, পশ্চিম এবং পূর্ব পাড়া সযত্নে পরিষ্কার করছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। বিকট গন্ধের মধ্যে ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। কেউ কেউ বলে থাকেন ওরা কাজ করে না। কিন্তু একবার ভাবুনতো, যারা ডাস্টবিনগুলো প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করছে, সমাজে এ ধরনের কাজ আমরা কতজন করি। কি দিতে পারি আমরা তাদের? একটি হুইল সাবান দিয়েছি এতেই খুশি তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদমিনার চত্ত্বরের ঘাসগুলো সবুজ হয়েছে। গত দেড়মাস থেকে সেখানে এক নাগাড়ে পানি দেয়া হচ্ছে ঘাসগুলোকে সতেজ সবুজ রাখার জন্য। প্রচণ্ড খরাতে অনেক জায়গার ঘাস পুড়ে গিয়েছে। কিন্তু শহীদমিনারের সবুজ ঘাস ডাকছে তার বন্ধুদের। প্রতি সন্ধ্যায় দেখা হতো তাদের সাথে যারা জন্মদিন পালন করতো, যারা আঞ্চলিক সংগঠনের সভা করতো সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীদের ভীষণ মিস্ করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদমিনার।

ভীষণ মিস্ করছে, নব নির্মিত জিমনেশিয়ামের পাশ্ববর্তী মাঠটি। ফল এসেছে মালটা গাছে। দেখতে ভীষণ ভাল লাগছে গাছগুলোকে। গাঢ় সবুজ পাতাগুলো দেখতে ভীষণ সুন্দর। কাঠবাদাম গাছগুলো যত্নে অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। পাশে দাঁড়ানো পলাশ গাছে নতুন কচিপাতা, কি অপূর্ব পরিবেশ দেখার কেউ নেই।

রাবি

বধ্যভূমি- সে আর আগের মতো নেই। চারিদিকে জঙ্গল ছিলো, এক ভূতুড়ে পরিবেশ। কিন্তু বধ্যভূমির সামনে চেয়ার-টেবিলে বসে থাকে পুলিশ ভাইয়েরা। পাশেই রয়েছে- ‘শতবর্ষে শতপ্রাণ’। দক্ষিণ দিকে ভীষণ মিষ্টি ফল- সবেদার বাগান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আখের জমিতে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কোদাল দিয়ে জমি পরিষ্কার করছে শ্রমজীবী মানুষ। কথা রাখছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার- ‘এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি রাখা হবে না’।

সবই আছে, এ মুহূর্তে নেই যাদের জন্য এ ক্যাম্পাস। কোথায় আছে, কেমন আছে! জানিনা। সবাই ভাল থাকুক, নিরাপদে থাকুক, ফিরে আসুক তাদের প্রিয় মতিহারে। জয় বাংলা।


লেখকঃ প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এশিয়ান ফ্লু

আনন্দ কুমার সাহা


১৯৫৭-৫৮ সালে এশিয়ান ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১০ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিলো। এশিয়ান ফ্লু-র উৎপত্তি হয়েছিলো চীন থেকে। এ ভাইরাসটিও ছিলো এভিয়ান ভাইরাস। অর্থাৎ পাখি জাতীয় প্রাণী থেকে এ ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে বিস্তৃতি ঘটায়।

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম গুইঝুই, চীন থেকে রিপোর্ট করা হয় এবং পার্শ্ববর্তী প্রদেশ ইউনানে বিস্তৃতি লাভ করে। এতে হাজারও হংকংবাসী আক্রান্ত হয়। একই সময়ে এ ভাইরাস সিঙ্গাপুরেও বিস্তার লাভ করে। তাইওয়ানে ১৯৫৮ সালের মে মাসে প্রায় ১লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়। ভারতেও প্রায় ১লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়।

১৯৫৭ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়। আক্টোবর মাসে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা এতে প্রথম আক্রান্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবীণ ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়।

এশিয়ান ফ্লু, ১৯৫৭

জনস্বাস্থ্য বিভাগ ভ্যাকসিন তৈরী করার জন্য ১৯৫৭ সালের ১২ই মে এই ভাইরাস, ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সাপ্লাই করে এবং অক্টোবর মাসে ১৯৫৭ সালে যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিন তৈরীতে সফলতা লাভ করে।

এশিয়ান ফ্লু-তে মৃত্যুর হার ছিলো শতকরা ৩ভাগ। তবে যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর হার ছিলো ০.৩%। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু-র চেয়ে এশিয়ান ফ্লু-তে অধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো। ভ্যাকসিন এবং এন্টিবায়োটিক আবিষ্কারের ফলে মৃত্যুর হার কম ছিলো। সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (CDC) এর মতামত অনুযায়ী ১১লক্ষ মানুষ মারা যায়। তারমধ্যে শুধু ল্যাটিন আমেরিকায় প্রায় ৭০হাজার থেকে ১লক্ষ ১০হাজার লোক মারা যায়।

১৯৫৮ সালের প্রথমদিকে যুক্তরাজ্যে ৯লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো, যারমধ্যে ১৪হাজার মারা গিয়েছিলো। গর্ভবতী মা, বয়স্ক লোক এবং ফুসফুসের অসুখে যারা ভুগছিলো তাদের জন্য এ ভাইরাস অত্যন্ত মারাত্মক ছিলো।

স্প্যানিশ ফ্লু এবং এশিয়ান ফ্লু মহামারি থেকে বিশ্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে- আশাকরি আমরা COVID-19 কে পরাজিত করতে সক্ষম হবো। জয় বাংলা।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য , রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনা ভাইরাস

আনন্দ কুমার সাহা


২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে মহামারি হিসেবে নতুন আবির্ভূত সার্স কোভ-২ ভাইরাসটির কারণে সৃষ্টরোগ কোভিড-১৯ নামে পরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত ১১ই মার্চ ব্যাধিটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


করোনা ভাইরাস: মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে DNA এবং RNA থাকে। কিন্তু ভাইরাসের মধ্যে DNA অথবা RNA থাকে। করোনা ভাইরাস হচ্ছে RNA ভাইরাস। ২০১৯ সালে আবির্ভূত ‘সার্স-কোভ-২’ হচ্ছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর করোনাভাইরাস। সার্স-কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো হচ্ছে- জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও খুসখুসে কাশি। বয়স্ক ব্যক্তিরা বা যাদের উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের সার্স-কোভ-২ দ্বারা মারাত্মক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।


তিন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বর্তমানে লক্ষ করা যায়, যেমন- SARS-COV (Severe acute respiratory Syndrome Coronavirus), MERS-COV (Middle East Respiratory Syndrome- Coronavirus), SARS-COV-2 (Severe acute respiratory Syndrome Coronavirus-2).


লক্ষণ কি?: সার্স কোভ-২ আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো হচ্ছে জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও খুসখুসে শুষ্ককাশি। সর্দি, গলাব্যথা, নাক কনজেশন, শরীরে ব্যথা এবং ডায়রিয়া দেখা দেয়। কেউ কেউ নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ যাদের আছে, সেই ধরনের ব্যক্তিরা ঝুঁকিতে থাকেন। আক্রান্ত ব্যক্তিরা ১৪দিন পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

কিভাবে সংক্রমিত হয়: যখন কেউ সাধারণ ফ্লুতে আক্রান্ত হয় অনেকেই একটু দূরত্ব রেখে চলাচল করে। কারণ ফ্লু ছোঁয়াচে। এক গবেষণায় দেখা গেছে একটি হাঁচির মাধ্যমে ১৬,০০০ ভাইরাস শরীর থেকে বের হয়- যার কিছু অংশ মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ফ্লু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কারণে হ্যান্ডসেক, কোলাকুলি, পাশে বসে নামাজ পড়া, ট্রেনে-বাসে যাতায়াত না করা বাঞ্চনীয়। স্প্যানিশ ফ্লু-র সময় কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিলো।

আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির তরল ড্রপলেটগুলোই করোনাভাইরাসের মূল বাহক। এই ড্রপলেটে প্রায় ৭০লক্ষ করোনা ভাইরাস থাকতে পারে বলে গবেষকরা মতামত দিয়েছেন। এই তরল ড্রপলেট রোদের প্রচণ্ড তাপে শুকিয়ে যায়, ফলে ভাইরাস বিস্তার লাভ করে না। ৩১শে মার্চ ২০২০ WHO-র মতামত সামাজিক শিষ্টাচার, দৈহিক দূরত্ব বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে মহামারি প্রতিরোধ সম্ভব।

রোগ প্রতিরোধ: দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া ও রান্নার বৈশিষ্ট্যের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের একটু বেশী। আমরা খাওয়ার সময় যে পরিমাণ ঝাল খাই- ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। আমাদের প্রত্যেকের বাসায় ওয়াশিং মেশিন বা ডিস্ক ক্লিনার নেই। হুইল সাবান দিয়ে কিংবা ছাঁই দিয়ে বাসন পরিস্কার করি। সাবান বা পাউডার দিয়ে জামা-কাপড় কাঁচি। এগুলোর মাধ্যমে আমরা হাত পরিস্কার রাখি।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হাতে ভাইরাস টিকে থাকতে পারে না। নামাজের পূর্বে ওজু করা- এটাও এক ধরনের ভাইরাস মুক্ত থাকা। যারা পূজাচর্চা করেন- সকালে স্নান করে পূজা দেন। এগুলো কাজে করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকা যায়। শ্রমজীবী মানুষ বা কৃষক সম্প্রদায় রোদের মধ্যে যেভাবে কাজ করেন- স্বাভাবিকভাবে তাদের করোনা ভাইরাস কিংবা অন্যান্য জীবানু প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী।

উষ্ণ আবহাওয়া: উষ্ণ আবহাওয়া ভাইরাসটির গতি অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। প্রত্যেক মাইক্রোঅর্গানিজম একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা এবং pH-তে দ্রুত বংশ বিস্তার করে। যেমন ঊ ঈড়ষর ব্যাকটেরিয়া ৩৭°C এবং pH ৭.২-তে ভাল বর্ধন করে। তেমনি গাছের নাইট্রোজেন আহরণের জন্য Rhizobium 28°C এবং ৬.৮ pH বংশ বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গবেষকদের মতে ৩২°C উপরে করোনা ভাইরাস দ্রুত বংশ বিস্তার করতে পারে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ৩৬-৩৯°C, যা করোনা ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক নয়। অনেকে প্রশ্ন করেন মানুষের শরীরের মধ্যে তাপমাত্রা ৩৭°C।

এটা সত্য যে, একবার পরিমাণ মত ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারলে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক তাপমাত্রা অধিক হওয়ার কারণে শরীরে প্রবেশ করবার পূর্বে ভাইরাস অনেকটাই টিকে থাকতে পারে না। এটা কিছুটা অনুমান ভিত্তিক ধারণা। পুরোপুরি গবেষণা না করলে সঠিক বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা এ মুহূর্তে আমাদের জন্য আশীর্বাদ এটা মনে করতে পারি।

SARS-COV ভাইরাস ২০০২-২০০৩ সালে চীনের গুয়াডাং প্রদেশে ও MERS-COV
২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছিল। ২০০২-২০০৩ সালের সার্স কোভ ভাইরাসের চেয়ে COV- 2 ভাইরাসের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন বেশী শক্তিশালী। এই শক্তিশালী হওয়ার কারণে ভাইরাসটি শ্বাস-প্রশ্বাস নালীর সঙ্গে ভালভাবে জড়িয়ে যায়। ড্রাগস কিংবা ভ্যাকসিন বাজারে আসার পূর্বে আমাদেরকে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সোসাল ডিসট্যান্স বা লক ডাউন করা ছাড়া আপাতত অন্য উপায় নেই।

১৯১৮-১৯ সালে যখন স্প্যানিশ ফ্লুতে মহামারি ধারণ করেছিল তখনও কিন্তু এই নিয়ম মেনে চলতে হতো। আমেরিকা ১৯৪০ সালে এশিয়ান ফ্লু-র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন বাজারজাত করে। খুশির খবর চীন ইতোমধ্যে অনেকটাই সফল হয়েছে SARS-COV-2 বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার ব্যাপারে। আশাকরি অতি শীঘ্রই ভ্যাকসিন বাজারে আসবে এবং আমরা মহামারি থেকে পরিত্রাণ পাবো।

আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যাঁরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন: ডাক্তার, নার্স, প্রশাসন বিশেষ করে সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, জনপ্রতিনিধি, সামরিক বাহিনী, পুলিশ-র‍্যাব, সাংবাদিক, নিরাপত্তা প্রহরীসহ পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের। এই দুর্যোগের মধ্যে তাঁরা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমি তাদের সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। জয় বাংলা।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

স্প্যানিশ ফ্লু

আনন্দ কুমার সাহা


স্প্যানিশ ফ্লু কি? ভাইরাসজনিত এক ধরনের জ্বর। যারা অবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ভাইরাস সম্পর্কে হয়ত ভাল ধারণা নাও থাকতে পারে। ভাইরাস কি একটি জীব? ভাইরাসকে আমরা একটা আদর্শ কোষ ( Cell ) বলতে পারবো? এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোষ কি? আমরা প্রায় সবাই জানি জইঈ কি। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গভাবে এটাকে কি বলা হয়। Red Blood Corpuscles/Cell? এটা একটি কোষ নয়।

কোষ হচ্ছে যার একটি নিউক্লিয়াস থাকবে, একটা আবরণ থাকবে এবং কোন বস্তুর সহযোগিতা ছাড়াই বংশবিস্তার করতে পারে। জইঈ তৈরী হয় কিন্তু বংশবিস্তার করে না। ভাইরাস বংশবিস্তার করতে পারে কিন্তু সেজন্যে তার সহযোগিতার প্রয়োজন। যেহেতু ভাইরাস সহযোগিতা ছাড়া বংশবিস্তার করতে পারে না সেহেতু আমরা ভাইরাসকে একটি আদর্শ কোষ বলতে পারি না। এটি স্বাভাবিক অবস্থায় বালুর দানার মতো পরিবেশে অবস্থান করে থাকে। যখন ভাইরাস পোষক দেহ (host body) পায় তখনই বংশবিস্তার করতে শুরু করে।

স্প্যানিশ ফ্লু জানুয়ারি ১৯১৮ থেকে ডিসেম্বর ১৯২০ সাল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এসময়ের মধ্যে পৃথিবী থেকে ৫ কোটি মানুষকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। স্প্যানিশ ফ্লু-র উৎপত্তি কোথায়? প্রথম মহাযুদ্ধের সময় স্পেন নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলো- যার কারণে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো এবং তেমন কোন শর্তারোপ ছিল না।

১৯১৮ সালের মে মাসে মাদ্রিদে প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তখন থেকে এটাকে বলা হত স্প্যানিশ ফ্লু। অবশ্য পাখি থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি হয় বলে এর আরেক নাম এভিয়ান ফ্লু (HINI)। আমরা টেলিভিশনে প্রতিদিন করোনা ভাইরাসের ছবি দেখি। লম্বা-লম্বা স্পাইক দেখতে পাই HINIহচ্ছে সেই স্পাইক- H= হেমাগ্লুটানিন, N= নিউরোএমাইনিডেজ। HI- কোন বস্তুর সঙ্গে লেগে থাকার জন্য সহায়তা করে আর NI- হচ্ছে নিউরোএমাইনিডেজ যা কোন বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ভাইরাসগুলো মিউটেশনের কারণে HI এবং NI-র সংখ্যা পরিবর্তন করতে পারে। যার ফলে সহজেই কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

প্রকৃতপক্ষে আমেরিকায় ১৯১৮ সালের ১১ই মার্চ প্রথম স্প্যানিশ ফ্লু ধরা পড়ে। ডাক্তাররা বুঝতে পারেনি কিভাবে স্প্যানিশ ফ্লুর আবির্ভাব ঘটলো, বা কিভাবে এর চিকিৎসা করা যায়। সে সময় কোন ভ্যাকসিন, এ্যান্টি ভাইরাল ড্রাগ যা ফ্লুকে প্রশমিত করে- কিছুই ছিলো না বা বিজ্ঞানও তখন বর্তমান সময়ের মত উন্নত ছিলো না। একারণে তখন ৫ কোটি লোক প্রাণ হারায়। মৃত্যুর হার শিশুদের মধ্যে বেশী ছিলো, তবে যুবক-বৃদ্ধ সবাই আক্রান্ত হয়েছিলো।

সে সময় কোয়ারেন্টাইন আরোপিত হয়েছিলো। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক, জনসমাগমপূর্ণ জায়গা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, মসজিদ, গীর্জা, মন্দির সবকিছুই বন্ধ ছিলো। বর্তমান সময়ের মতো হ্যান্ডশেক নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। ঘরে থাকার জন্য বলা হয়েছিলো। রাস্তা-ঘাটে থুথু ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এমনকি বয়েজস্কাউটরা রাস্তায় যাতে কেউ থুথু না ফেলে তার জন্য তারা স্বেচ্ছাশ্রমও দিয়েছিলো।

চিকিৎসার জন্য এ্যাসপ্রিন ব্যবহার করার নির্দেশনা ছিলো। প্রতিদিন ৩০ গ্রাম করে খাওয়ানোর নির্দেশ ছিলো, যা বর্তমানে কল্পনাও করা যায় না। মূলত ৪ গ্রাম করে এ্যাসপ্রিন খাওয়াও সঠিক নয়। অনেকে এ্যাসপ্রিন ওভারডোজে বিষাক্ত হয়ে মারা গিয়েছিলো।

এত মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো যে, হাসপাতাল, ব্যক্তিগত বাসা, স্কুল, কলেজকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছিলো। বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ এর আক্রান্তে মৃতদের নিউয়র্ক সিটিতে দাফন করার জায়গা নেই। অনেক দূরে মৃত ব্যক্তিদের দাফন করা হচ্ছে। সে সময় অসুস্থতার সংখ্যা অনেক বেশী ছিল বলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি জমি থেকে ফসল কেটে আনার মতো লোক পাওয়া যায়নি। অর্থনৈতিকভাবে গোটা বিশ্ব পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিলো।

স্প্যানিশ ফ্লু-তে উল্লেখযোগ্য যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডী ১৯১৮ সালের ২২ই নভেম্বর তারিখে, ব্রাজিলের ২য় বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ১৬ই জানুয়ারি ১৯১৯, সাউথ আফ্রিকার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ১৯১৯ সালের ২৭শে আগস্ট, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ২৬শে অক্টোবর ১৯১৮, জন হপকিনস্ হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ১৯১৯ সালের ২৯শে ডিসেম্বর এবং আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাদাও স্প্যানিশ ফ্লু-তে আক্রন্ত হয়ে মারা যান।

বর্তমান সময়ে আমরা রাষ্ট্রচালানোর জন্য একজন ভাল মাঝি পেয়েছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে- সেদিকে খেয়াল রেখে নৌকার মাঝি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করছেন। আশাকরি মেঘ অচিরেই কেটে যাবে এবং নতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে বাংলাদেশ। জয় বাংলা।


লেখকঃ অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, উপ-উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

অ্যালকোহল ও হুজুগে বিজ্ঞানী

ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম


অ্যালকোহল দিয়ে করোনাভাইরাস মারার নতুন পদ্ধতি নাকি আবিষ্কার করছেন। অ্যালকোহল যদি জীবাণুনাশ বা ভাইরাস না মারত তাহলে কেন আমরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার কথা বলি।

স্যানিটাইজারেতো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহল বা ইথানল থাকে। ৭০% ইথানল তো স্বাভাবিকভাবেই জীবাণুনাশক। তিনি (গবেষক) আবার বললেন সরকার বললে তিনি গবেষণা শুরু করবেন। হায়রে গবেষণা, আর হায়রে গবেষক!! ইনকজেক পুশ করার আগে কি কখনই ডা. বা নার্স অ্যালকোহল দিয়ে আপনার হাত পরিষ্কার করেনি?

১৩৬৩ সাল থেকেই অ্যলকোহল এন্টিসেপটিক হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ নতুন আবিষ্কার বলে জাতীয় টেলিভিশন গুলোও তা প্রচার করছে। সাংবাদিকরাও আর নিউজ পায়না। পশ্চিমা দেশ গুলোতো তো অ্যালকোহল পানই করে। তাদের কেন এত করোনা ইনফেকশন হয় বা করোনায় মারা যাচ্ছে?

তবে চায়নাতে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া অনেক লোকই বলেছেন তারা গরম পানির বাষ্প নিয়েছেন যা নিয়োমোনিয়া বা শ্বাস কষ্ট লাঘব করে। আর করোনা ফুসফুসে আক্রমণ করে বিধায় সাধারণ উপসর্গ জ্বর ও কাশির সাথে সাথে শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাটিই মূলত ভোগায়। তাই গরম পানির বাষ্প হয়তো সুফল বয়ে আনে।

এছাড়া বাংলাদেশে যেখানে ভেজাল যুক্ত মদ খেয়ে অনেক লোক মারা যায়, সেখানে ভেজাল মুক্ত অ্যালকোহল পাওয়া খুবই দুষ্কর। যারা মলিকিউলার বায়োলজির গবেষণা করেন তারা বিশুদ্ধ অ্যালকোহলের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে ভালো জানবেন। তাই শেষে দেখা যাবে ভেজালযুক্ত অ্যালকোহলের বাষ্প নিয়ে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

ধন্যবাদ ড.হাসানুজ্জামান কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে প্রকাশিত একটি দূর্বল আর্টিকেল কমেন্টে যুক্ত করার জন্য, যেটি আমাদের গবেষক কপি করে বড় বিজ্ঞানী হবার চেষ্টা করছেন। উলেখ্য যে, এটি কোন জার্নাল না। ফলে এটার পিয়ার রিভিউ নেই। এটা অনলাইন রিপোজিটরি। সবশেষে বলে রাখি, ইরানে কিন্তু করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য অ্যলকোহলের গুজব শোনে ভেজাল মদ খেয়ে ইতিমধ্যে ৭৩ মতান্তরে ১০০ বা ৬০০ লোক মারা গেছে।

মনে রাখবেন, অ্যালকোহল লিভার ড্যামেজ ও ক্যান্সার সহ প্রায় ২০০ ধরনের রোগ আপনার শরীরে সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যালকোহল থেকে এর বাষ্প বেশি ক্ষতিকর। কারণ এটি সরাসরি ব্রেইনে চলে যায়। ফলে নেশা তীব্র হয় এবং এটি ফুসফুসকে ড্যামেজ করে। আর যা ফুসফুসের ড্যামেজ করে তা কি করে করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়? করোনা ভাইরাসও তো ফুসফুসের ক্ষতি করে। আপনারা কি করবেন? বিষয়টি ভেবে দেখেন।


লেখকঃ অধ্যাপক, ড. মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ফার্মেসি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

করোনা প্রার্দুভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন


করোনা প্রার্দুভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন: বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীদের মানবীয় গুণাবলীর উপস্থিতি শীষর্ক একটি গবেষণার প্রাথমিক রিপোর্ট।


আবু জাফর আহমেদ মুকুল, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম


ইউরোপ বা আমেরিকায় স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অংশগ্রহন করতে হয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে Volunteer work (সেচ্ছাসেবা) করার জন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং কাজটিকে কোর্স ক্রেডিট হিসেবে গণনা করা হয়।

সংবাদ পত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনা প্রার্দুভাবে আইন শৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ইংল্যান্ডে প্রায় ২৬,০০০ ও ইতালিতে প্রায় ২৩,০০০ সাধারন প্রশিক্ষিত লোক সেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে এবং এর একটা বড় অংশই শিক্ষার্থী। করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য চার ধরনের স্বেচ্ছাসেবক (স্বাস্থ্যক্ষেত্র, যোগাযোগ, ঘরে বসে উৎপাদন এবং জরুরি সেবা) চেয়ে গণমাধ্যম এবং সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে ভারত সরকার।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই আবার আলাদা কিছু বিবেচ্য বিষয় আছে। যেমন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ আছে। শুধু মাত্র চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাই এ কাজে যোগ দিতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, যোগাযোগ ক্ষেত্রেও নানা ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে। বাড়িতে বসেই সরকারের বিভিন্ন হেল্পলাইন অপারেট করা করা সম্ভব। তৃতীয়ত, বাড়িতে বসে উৎপাদন ক্ষেত্রেও কাজ করার সুযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে কোনও সংস্থা স্যানিটাইজার এবং মাস্ক উৎপাদন করে সরকারকে দিতে পারে। আর, চতুর্থ ক্ষেত্রটি সরাসরি প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য,যেমনঃ পুলিশ, সরকারি প্রশাসকদের সহকারি হিসেবে কাজ করার।

গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই স্বেচ্ছাসেবীদের তালিকায় ভারতে নাম লিখিয়েছেন প্রায় ৩৪ হাজার জন আর প্রায় ১৫০০টি সংস্থা তাদের নাম নথিভুক্ত করেছেন। জাপানে স্কুলে প্রত্যেকটি বাচ্চার বৈশিষ্ট্য বিষয়ে শিক্ষকগণ পর্যবেক্ষন রাখেন এবং মানবতাবোধ তৈরি করেন।

বাস্তবতা হলো: বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে ভারতশ্বেরী হোমস্সহ মাত্র কয়েকটি স্কুল স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

কিন্তু সারা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি ভারতশ্বেরী হোমস্ এর মতো স্বেচ্ছাসেবীর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো, তাহলে দেশে স্বেচ্ছাসেবা কাজ করার মতো লোকের অভাব হতো না। সুতরাং শিশুকালে বীজ বপন করা জরুরি। পরিবার থেকে কলেজ পর্যন্ত মানবিক কাজের প্রতি ধারাবাহিকতায় থাকলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা স্বেচ্ছাসেবী কাজটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

আমাদের দেশে এখনও সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে এই স্বেচ্ছাসেবকদের সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। এখনই তাঁরা কাজ শুরু করে দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শিখে যাবেন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্বেচ্ছামূলক কাজটি এখন তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে কাজটি করে থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তবে এটি যদি শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন থাকতো আমাদের দেশেও প্রায় ৫০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী আইন শৃঙ্খলার বাহিনীসহ সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করার একটি প্লাট ফর্ম তৈরি হতো।

এ বিষয়ে আমরা গত মার্চ ১০ থেকে ৩১, ২০২০ইং পর্যন্ত বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন যারা বিভিন্ন লেভেলে বা সেমিস্টারে অধ্যয়নরত সিজিপিএ (৩.৫ নীচে) পাওয়া ৮০ জন, সিজিপিএ (৩.৫- ৩.৭৫) পাওয়া ৫৫ জন এবং সিজিপিএ (৩.৭৬- ৪.০০) পাওয়া ১৫ জনসহ সর্বমোট ১৫০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাদের গবেষণার অংশ হিসেবে একটি জরিপ চালাই।

এরপর পারফরম্যান্স মূল্যায়নের জন্য মানবীয় গুণাবলীর সম্পর্কীত বিভিন্ন প্রশ্ন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী দ্বারা টেলিফোন ইন্টারভিউ ও অনলাইনে মাধ্যমে পূরন করানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের সেমিস্টারের সিজিপি এর উপর ভিত্তি করে শ্রেনী বিন্যাস করা হয় যা নিম্নে প্রাথমিকভাবে তুলে ধরা হলঃ

১.বিশ্ববিদ্যালয়ে সিজিপিএ (৩.৫ নীচে) পাওয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা (৬৫ জন) বেশি মানবীয় গুণাবলী ধারণ করে যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৬২%। volunteer worker হিসেবে তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বেশি পছন্দ করেন।

২. সিজিপিএ (৩.৫- ৩.৭৫) পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে (৩৬ জন) মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৩৪%।

৩. সিজিপিএ (৩.৭৬- ৪.০০) পাওয়া শিক্ষার্থীরা (৪ জন) মানবীয় গুণাবলী ধারন করে যার সম্ভাব্য হার প্রায় ৪% । তারা নিজেরে ক্যারিয়ারের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। বেশির ভাগ মনে করেন স্বেচ্ছামূলক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এটি তাদের দায়িত্ব নয় এবং রাষ্ট্র/কর্তৃপক্ষ এককভাবে বিষয়টিতে দায়বদ্ধ। স্বেচ্ছামূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণও খুবই কম এবং পরিবার থেকেও উৎসাহ কম পান তাঁরা। তবে ক্ষেত্র বিশেষে লক্ষ্য করা যায়, ১% মানবতা অনেক সময় ব্যক্তি বিশেষে ১০০% স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।

৪. বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মনে করেন, ক্লাসে ১% শিক্ষক দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন । সারা বছর ৩% শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করে থাকেন এবং বেশির ভাগ শিক্ষকগণ সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা শ্রমে যে সকল শিক্ষার্থী নিয়োজিত তাদেরকে নেগেটিভ দৃষ্টিতে দেখেন এবং একাডেমিক কাজে সহায়তা কম করেন । শিক্ষকদের মধ্যে মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব/পেশাগত হিংসা থাকায় অনেক জুনিয়র শিক্ষক সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাথে স্বেচ্ছামূলক কাজ করতে আগ্রহী হন না। অথচ, বিপরীতক্রমে জাতীয় ক্রান্তি লগ্নে/ করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময়ে প্রায় ৬৭% শিক্ষক শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রশংসা করেন।

৫. বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দেশপ্রেম ও মানবতার প্রতি সচেতন কিন্তু শারীরিক কাজ করতে আগ্রহ কম । সারা বছর ৭% শিক্ষার্থীরা সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছামূলক কাজের প্রতি উদ্ভুদ্ধ করে এবং বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সংগঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছা শ্রম নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন এবং একাডেমিক পড়ায় মুখস্থ করতে বেশি পছন্দ করেন । জাতীয় ক্রান্তি লগ্নে/ করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময়ে প্রায় ১৫% শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছামূলক কাজ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং ৬% শিক্ষার্থীকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে লক্ষ্য করা যায়।

উপরের পাই চার্টে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে মানবতার শতকরা হার বর্ননা করা হয়েছে তা ব্যক্তি বিশেষে তারতম্যও হতে পারে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি ও বৃহত্তর ক্ষেত্র বিবেচনায় উপরের উল্লেখিত ফলাফলের বাস্তবতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করে।

মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষা নীতি বিষয়ে বলেন,”শিক্ষার বিষয়টা শুধু পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কিংবা সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। শেখার মধ্য দিয়ে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা, যেকোনো সমস্যাকে মোকাবিলা করা ও গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন, মানবিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম—সবকিছুই শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।”

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন,” আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি যে, এখনকার জিপিএ-৫ নির্ভর প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখার যে প্রচলন রয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীরা যে বিদ্যার্থী, তা থেকে বের হয়ে কেবল পরীক্ষার্থী হয়ে গেছে। পড়াশোনার উদ্দেশ্য যে কেবল সার্টিফিকেট অর্জন নয়, প্রকৃত বিদ্যা অর্জন, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে গেছি।” আমাদের গবেষণায় সাথে শিক্ষা নীতি নির্ধারকের মতামতের সাথে যথেষ্ট মিল লক্ষ্য করা যায়।

তবে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সময় নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার্থীরা সকালে থিউরি ক্লাস পরে বিকালে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীরা এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন নিয়ে ব্যাপক ব্যস্ত থাকে।

তাছাড়া, শিক্ষার্থীরা একাডেমিক বিভিন্ন কোর্সের পরীক্ষার চাপের পাশাপাশি ব্যাপক হারে বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকুরির কেন্দ্রিক প্রস্তুতিতে বেশি মনযোগী। শিক্ষার্থীদের ১ম প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জিপিএ পাবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা হ্রাস করে মানবতা ও দেশপ্রেম উপলব্ধি করা দরকার।

আশা করছি, এরই ধারাবাহিকতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের একাডেমিক মুখস্থ বিদ্যার উপর বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্রায়োগিক ও মানবিক বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্ব দিবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ এ বিষয়ে আন্তরিক ও শিক্ষার্থীদের উদ্ভুদ্ধ করলে বাংলাদেশের যে কোন ক্রান্তিকালে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাই অন্যান্য দেশের মতো প্রশিক্ষিত ও সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের তরুন শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের নেতৃত্বের বাহক।আর, তাই এই শিক্ষার্থীরা মানবিক হলে দেশটার চিত্রই বদলে যাবে।


লেখকবৃন্দ : শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর শিক্ষক ।

করোনাকাল শেষে খাদ্যের যোগান নিশ্চিতে বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষকের ১০ পরামর্শ

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস জনিত সংকট পরবর্তী সময়ে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে দশটি পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) কৃষি বিভাগের প্রভাষক অভিজিৎ বিশ্বাস

পরামর্শগুলো হলোঃ

১. কৃষি উৎপাদনে সকল প্রকার জমির (বাড়ির আঙিনার জমি, পাহাড়ি জমি) ব্যবহার নিশ্চিত করা।

২. দেশের সকল পর্যায়ের কৃষকদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কৃষি পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা।

৩. কৃষকদের স্বল্প সময়কাল ও উচ্চফলনশীল বা হাইব্রিড জাতসমূহ চাষাবাদে আগ্রহী করে তোলা।

৪. আমন মৌসুমে প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে DRR কৌশলগুলোর ব্যবহার করা। ( যেমনঃ ভাসমান কৃষি, মিশ্রচাষ ইত্যাদি)

৫. আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মৌসুমে চাষাবাদযোগ্য অঞ্চলভিত্তিক cropping system প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।

৬. কৃষকদের যান্ত্রিক কৃষি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান সহ সকল ধরনের সহযোগিতা ( সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষিঋণ) নিশ্চিত করা।

৭. বিভিন্ন শস্য ও সবজির বীজ সংরক্ষণ সহ উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ করা।

৮. শহর এলাকায় পতিত জমিতে সবজি চাষ ও Rooftop agriculture (ছাদকৃষি) বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করা।

৯. শস্যদানা (ধান, ডাল) উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি, ফলমূল, মাছ ও মাংস উৎপাদনের আনুপাতিক হার সঠিক রাখা।

১০. কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে অঞ্চলভিত্তিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখা।

করোনা মোকাবেলায় কি করবেন আর কি করবেন না?: প্রফেসর ড. আবুল হোসেন

প্রফেসর ডঃ মোঃ আবুল হোসেন


করোনা ভাইরাস আক্রমণের মহাবিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলো অনুসরণ করুন (দেশ-বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও স্ববিবেচনা থেকে সংকলিত)।

করোনার বিস্তার, প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও মৃত ব্যক্তির দাফন বিষয়সহ বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন এবং-প্রচার করুন।

১। করোনা ভাইরাসের ভয়ঙ্কর বিস্তার লাভ যেভাবে হচ্ছেঃ-

(ক) ভাইরাসটি নিত্য নতুন জাত পরিবর্তনে সক্ষম বিধায় ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাই উন্নত রাষ্ট্রও তাদের লাশের স্তূপে থমকে গেছে।

(খ) আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি (ছয় ফুটের মধ্যে থাকলে), নাকের পানি, সর্দি, থুতুর সংস্পর্শে আসলেই আক্রান্ত হতে পারেন।

(গ) ভাইরাসটি কাগজ ও টিসু পেপারে ত্রিশ মিনিট, কাপড়চোপড়ে চব্বিশ ঘণ্টা, স্টেইনলেস স্টিলের উপর চার দিন, সার্জিক্যাল মাস্কে সাত দিন, কোন কোন বস্তুর উপর দশ দিন পর্যন্ত এবং ফ্রিজের জিনিসে প্রায় দুই সপ্তাহ নির্জীবের মত থাকতে পারে এবং উল্লেখিত সময়ের মধ্যে এসব স্থান থেকে মানব দেহে প্রবেশের পর কর্মক্ষম হয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে।

(ঘ) একারণেই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, সর্দি, থুথুর মাধ্যমে ভাইরাসটি গণপরিবহন যথা- রিকসা, বাস, ট্রেন ইত্যাদির সুইচ, হাতল, দরজা, জানালা, টয়লেট, দেয়ালের সাথে লাগতে পারে এবং এসবের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে।

(ঙ) একই কারণে এ ভাইরাস বাজারের মালামাল, শরীরের কাপড়চোপড়, মাছ মাংস, সবজি, ফলমূল, ইত্যাদিতে লাগতে পারে এবং এসবের স্পর্শে আসা হাতের মাধ্যমে আপনার নিকটজনও আক্রান্ত হতে পারে।

২। নিম্নরূপে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলুনঃ-

(ক) ভাইরাসটি ঘনঘন জাত পরিবর্তনে সক্ষম বিধায় প্রতিরোধী ভ্যাক্সিন/ঔষধ আবিষ্কার কঠিন হয়ে পড়েছে, একমাত্র আল্লাহ তাআলার রহমতেই এর বিস্তার রোধ হতে পারে
তাই সকল প্রকার অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত হয়ে যার যার ধর্ম মোতাবেক কায়মনোবাক্যে আল্লাহ/ সৃষ্টিকর্তাকে ডাকুন, মুসলিমগণ তওবা পড়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও সাহায্যের জন্য দোয়া করুন।

উন্নত দেশগুলো (যেমন ইতালি) এ ভাইরাস প্রতিরোধে সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য আশা করছে।

(খ) লকডাউন ও হোম কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা মেনে চলুন, সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা ও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলুন ।

অযথা একাধিক ব্যক্তি একত্র হবেন না, কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলুন, ফেস মাস্ক ব্যবহার বা পরিষ্কার কাপড়, শাড়ির আঁচল, ওড়না, রুমাল অথবা গামছা দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে চলুন।

অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাজার বা গণজমায়েতে যাবেন না, বয়স্ক লোকজনকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বাড়িতেই রাখুন।

জরুরী দীর্ঘ যাত্রাকালে সময় সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হেক্সিসল ব্যবহার করুন।

(গ) বাইরে থেকে আবাসস্থলে অথবা বাড়ীতে পৌঁছার সাথে সাথে অন্য কোনো কিছু স্পর্শ করার পূর্বেই আপনার হাতদুটো সাবান বা লিকুইড হ্যান্ড ওয়াশ দ্বারা ভালো করে ধুয়ে নিন, তারপর নাক মুখের ভেতরসহ মুখমন্ডল পরিষ্কার করুন।

গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে ধোয়ার ব্যবস্থা করুন, সম্ভব না হলে কড়া রৌদ্রে কয়েক-ঘন্টা ওলটপালট করে শুকিয়ে নিন ।

বাজার থেকে আনা কাঁচামাল যথা লাউ কুমড়া, শাক সবজি, শসা, কলা, শিম, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি ব্যাগসহ কয়েকবার ধুয়ে হালকা রোদে বা বাতাসে শুকিয়ে নিন। নচেৎ এসব তরকারি কাটার সময় তা থেকে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন, মাছ মাংস দ্রুত ধুয়ে রাখুন।

বাজার থেকে আনা শুকনা দ্রব্যাদি পৃথক ঘরে বা পৃথক স্থানে কমপক্ষে ১০-১২ ঘন্টা রাখার পর ব্যবহার করুন ।

কমপক্ষে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় খাদ্যদ্রব্য গরম করে খাবেন ।

বাসা/অফিস/গণপরিবহনের চাবি, সুইচ,হাতল, দরজা,সীট ইত্যাদি পরিষ্কার রাখুন এবং ১ঃ৪৯ অনুপাতে সাবান-পানি, ব্লিচিং সলিউশন বা ৭০ % ইথানল দ্বারা মাঝেমধ্যেই মুছে রাখুন।

বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন, বাথরুম ব্যবহারের পর সাবান-পানি দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিবেন বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দ্বারা জীবাণুমুক্ত রাখুন ।

রোগীর কাপড় চোপড়, বালিশ বিছানার কভার ইত্যাদি ফুটন্ত পানিতে ধূয়ে নিন, অন্যদের গুলোও নিয়মিত পরিষ্কার করুন।

(ঘ) শারীরিক ইমিউনিটি মজবুত করার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে শক্ত থাকুন, উপরোল্লিখিত কাজগুলো করুন, না পারলে ব্যায়াম করুন। মনে রাখবেন পরিশ্রমই আপনার শরীরকে ভাইরাস প্রতিরোধী করতে পারে ।

ইমিউনিটির জন্য রোগীসহ সকলেই লেবুর তিন-চারটে পাতলা টুকরা ঘুটে নিয়ে উষ্ণ লেবু পানি পান করুন, পাশাপাশি সারাদিন ঘন ঘন প্রচুর হালকা উষ্ণ পানি বা নরমাল পানি পান করুন, প্রচুর ভিটামিন সি যুক্ত টক জাতীয় ফল খাবেন, সম্ভব হলে মাল্টিভিটামিন খাবেন।

করোনাভাইরাস গলায় তিন-চারদিন ইনকিউবেশনের থাকে, তারপর শ্বাসনালীতে ও ফুসফুসে যায়। তাই বাইরে থেকে বাড়িতে আসার পর পরই এবং বাড়িতে থেকেও সারাদিন কমপক্ষে ২-৩ বার উষ্ণ লবণ-পানি বা নরমাল পানি দ্বারা গড়গড়া করুন।

ইসলাম ধর্ম মোতাবেক মাঝেমধ্যেই মধু ও কালোজিরা খাবেন ।

(ঙ) এসময় দোকানে পান সুপারি, চা-কফি (মেশিন-মেড ছাড়া) খাবেন না। কারণ একই পাত্রের দূষিত পানিতে এসব ধৌত করা হয়। কেবল বাড়িতে পান সুপারি ভালো করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে খেতে পারেন।

অন্যজনের মুখে দেয়া বিড়ি, সিগারেট, রুমাল, গামছা, টাওয়েল ইত্যাদি ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না, এ সুযোগে এসব বদ অভ্যাস ত্যাগ করুন।

খাদ্যদ্রব্য অযথা মজুদ করবেন না, মনে রাখবেন বেচাকেনা দীর্ঘদিন বন্ধ থাকবে না। তাছাড়া এসব করতে যেয়ে সবাই মারা গেলে আপনার মজুদ দ্রব্যাদি কে খাবে? একইভাবে দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফাখোরেরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার অর্থই বা কে ভোগ করবে?

(চ) যারা বাইরে চাকরি বা ব্যবসার সাথে যুক্ত আছেন তারা ঘরে ফিরেই অন্য কারো দ্বারা দরজা খোলা ও বন্ধ করাবেন, হাত সাবান দিয়ে ধোয়ার পর ব্যাগ পোশাক ইত্যাদি সরিয়ে রেখে পুনরায় হাত মুখ ধুয়ে নিন ।

ঘরের সংখ্যা কম থাকলে একই কক্ষে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করুন, টাকা-পয়সা মানিব্যাগ অফিস ব্যাগ ব্যবহারের সাথে সাথেই পুনরায় হাতমুখ ধুয়ে নেবেন।

বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিবর্গ একইভাবে বাড়িতে অতি সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করবেন (সম্ভব হলে পৃথক ঘরে), ১৪ দিনের মধ্যে অসুখের উপসর্গ দেখা না গেলে তারা আক্রান্ত নন প্রমাণিত হলেও পরবর্তীতে তারা এখানে থেকেও আক্রান্ত হতে পারেন।

৩। চিকিৎসা ব্যবস্থাঃ-

(ক) করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরে জ্বর, মাথাব্যাথা, গলা-ব্যাথা, নাক দিয়ে পানি ঝরা, গা চাবানি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যেতে পারে এবং আক্রমণের সাত দিনের মাথায় এসব কমে যেতে পারে ও সর্দি ঘন হতে পারে, যদি তা হয় তবে বুঝতে হবে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অন্য কোন সমস্যা না হলে চিকিৎসকের প্রয়োজন হবে না।

প্রকৃতপক্ষে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়া ভাইরাস রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, তবে শরীর ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদিসহ সেকেন্ডারি ইনফেকশন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাই পূর্বে উল্লেখিত উপসর্গ দেখা গেলে এবং চিকিৎসক না পাওয়া গেলে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে দিনে ৩/৪ টি প্যারাসিটামল খাওয়ার পর খাবেন, হাঁচি-কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়লে অ্যান্টিহিস্টামিন যথা- এলাট্রল বা ফেক্সো দিনে একটি করে ট্যাবলেট খাবেন।

ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলুন, উষ্ণ পানি ব্যবহার করুন, ঘনঘন লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করুন, প্রচুর লেবু পানি বা নরমাল পানি পান করুন।

(খ) এসবের পরেও যদি আপনার জ্বর, শরীর ব্যাথা , মাথা ব্যাথা না কমে বা ঠান্ডা নিউমোনিয়ার মতো বা চেস্ট ইনফেকশন এর মত মনে হয় সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন বা নিকটবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্রে যাবেন ।

যে কারণেই হোক, আক্রান্ত হলে নিজের হাঁচি-কাশি, সর্দি , থুথু ইত্যাদি যেন কোথাও না লাগে, তাই রোগীকে অবশ্যই পরিষ্কার ফেস মাস্ক বা পরিষ্কার রুমাল , গামছা , টাওয়েল , ওড়না , শাড়ির আঁচল ইত্যাদি ব্যবহার করার পর সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।

এভাবে নিজে ভাল থাকুন, দেশ ও জনগণকে বাঁচতে দিন, আল্লাহ আপনার সহায় হবেন।

৪। মৃত ব্যক্তির সৎকার/ দাফন প্রক্রিয়াঃ-

আল্লাহ না করুন , করোনায় কেউ মারা গেলে তার নিকট থেকে দূরে থাকুন , দ্রুত দাফন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নিন- যেমন কবর খনন , বাঁশ , পলিথিন বা চাটাই ইত্যাদির ব্যবস্থা সহ মৃতদেহকে গোসলের জন্য বিশেষ করে গ্রামের বাড়ির নির্ধারিত জায়গায় এমনভাবে বড় গর্ত করুন যেন বাতিলযোগ্য কাপড় ও ময়লা পানি তার মধ্যে পুতে ফেলা যায়। পুর্ব থেকেই বেশি পানির ব্যবস্থা রাখুন ।

পূর্ব থেকেই মৃতদেহ বহনের খাটিয়ার ভিতর পলিথিন বিছিয়ে বা অন্য কোন ব্যবস্থা এমন ভাবে করবেন যেন মৃতদেহের কোন জলীয় পদার্থ বাইরে না পড়ে ।

চার পাঁচজন যুবক ও শক্ত মধ্যবয়সী ব্যক্তিবর্গের , যারা মৃতদেহ ধোয়া , কাফন পড়ানো ও কবরে নামানোর দায়িত্ব পালন করবেন, অজু অবস্থায় তাদের শরীর পলিথিন বা পরিষ্কার কাপড় দ্বারা মুড়িয়ে নিন, চোখে চশমা ও নাক-মুখ মাস্ক বা কাপড় দ্বারা ঢেকে নিন, সম্ভব হলে হ্যান্ড গ্লাভস পড়ুন।

এ অবস্থায় তারা মৃত দেহকে গোসল করিয়ে, কাফন পড়িয়ে , নতুন কাফন না থাকলে বাড়ির পরিষ্কার কাপড়কে কাফন বানিয়ে জানাযার ব্যবস্থা করবেন , তারপর মৃতদেহ কে কবরে শুইয়ে দিয়ে খাটিয়াটি নিয়ে গোসলের স্থানে রেখে শরীরের পলিথিন , কাপড় ইত্যাদি নষ্ট করতে চাইলে গর্তে ফেলে দিন , খাটিয়াটি সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে দিন।

অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গর্তে ফেলুন , অন্যান্য দ্রব্যাদি সাবান দিয়ে ধুয়ে তারপর গর্ত ভরাট করে গোসলে যাবেন।

এ সময় অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ দাফন প্রক্রিয়া শেষ করে কোন গল্পগুজব না করে দ্রুত নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে পূর্ববর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।

মনে রাখবেন এ দুর্যোগের সময় গণজমায়েতের সুযোগ নেই, দূরের আত্মীয়-স্বজনকে না আসতে বলে দোয়া করতে বলবেন, তাদের আসার জন্য দেরি করবেন না, পাড়া-প্রতিবেশী দ্বারা দাফন সম্পন্ন করুন।

আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। আমীন।



লেখকঃ প্রফেসর ড. মোঃ আবুল হোসেন, আহবায়ক, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন সহায়ক সংগঠন, শিবগঞ্জ, বগুড়া এবং প্রফেসর (চুক্তিভিত্তিক), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি), গোপালগঞ্জ। (ভূতপূর্ব প্রফেসর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ)।



 

করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবেলায় নৃবৈজ্ঞানিক জ্ঞান

মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন


পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষজন নিয়মিতভাবেই বিবিধ প্রকারের আকস্মিক ঝুঁকি ও দুর্যোগ মোকাবিলা করে চলেছে। কোথাও প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খড়া, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্প), আবার কোথাও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ (বায়ু দূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা ও বন নিধন)। যা তুলনামূলক বেশি ঘটে ।

এছাড়াও স্থান-কাল-নির্বিশেষে কিছু দুর্যোগ ঘটতে দেখা যায় যেগুলি সম্বন্ধে আগে থেকে অনুমান করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ- ইবোলা ভাইরাস, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের আঘাত। যে ধরণের দুর্যোগই ঘটুক না কেন, এগুলির প্রভাব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রশাসনিক দক্ষতা, আয়-বৈষম্য, ক্ষমতা-কাঠামো ও সম্পদে জনগনের প্রবেশাধিকারের চলমান অবস্থা স্পষ্ট হয়। অন্যভাবে বললে, সমাজের প্রান্তিক কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষগুলিই সবচেয়ে আগে ও বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ঐতিহাসিকভাবে এটি ঘটে এসেছে। যা, কোনোভাবেই কাম্য নয়।

দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরণের জরুরী সেবা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন দেখা দেয়। তন্মধ্যে পরিবেশ বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, চিকিৎসক, মানবধিকার কর্মী ও প্রকৌশলীগণ অন্যতম। সামাজিক বিজ্ঞানীদের অবদানও উল্লেখযোগ্য; যেমন- অর্থনীতিবিদগণ দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি অর্থের পরিমাপে হিসাব করে দেখান যে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কি পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন যা দিয়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জরুরী সেবা প্রদান করা যেতে পারে।

দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে আরও কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেগুলি প্রেক্ষিত নির্ভর, জটিল, মানুষের সাংস্কৃতিক আচরণ, বোধ ও শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত। এক কথায়, এগুলো পৃথক বা স্বতন্ত্র কোনো বিষয় নয়। এই বিষয়গুলির আন্তঃসম্পর্ক সরল কিংবা অপ্রশিক্ষিত দৃষ্টিতে ধরা পড়েনা। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত পর্যবেক্ষণমূলক দক্ষতা ও সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ডের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই প্রবন্ধে আমার বক্তব্য নৃবিজ্ঞানের ভূমিকার উপর সীমাবদ্ধ রাখবো এবং বিষয় হলো বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে করোনাভাইরাস দুর্যোগ।

সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগ অধ্যয়নকারী সামাজিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ভূগোলবিদ বেন উইজনার ও পিয়ারস ব্লেইকি এবং নৃবিজ্ঞানী এন্থনি অলিভার-স্মিথ ও সুসানা হফম্যান। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও এদের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু সামাজিক বিজ্ঞানী। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত ও নৃবিজ্ঞানী এম. কিউ. জামান। সুতরাং, দুর্যোগ সম্পর্কে সামাজিক বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা নতুন কোনো বিষয় নয়। খুব সরল ভাষায়, নৃবিজ্ঞান এমন একটি জ্ঞানকান্ড যেটি মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ধার্মিক ও বিভিন্ন ধরণের আচরণসমূহকে গুণগতভাবে ও সার্বিকভাবে অধ্যয়ন করে।

নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ড তার গবেষণা পদ্ধতি (যেমন, অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ) দ্বারা দুর্যোগ সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের ধারণায়ন, শঙ্কা ও অভিজ্ঞতাকে চিত্রায়ন করে। নৃবিজ্ঞানের অন্যতম হাইপোথিসিস হলো যেকোনো বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিভিন্ন হতে পারে। এটি যে কোন দুর্যোগ বা ঝুঁকিকে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা “সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত” হিসেবে বুঝে না। বরং, এর চাইতেও বেশি কিছু। আকস্মিক দুর্যোগ-তাড়িত ঝুঁকিতে তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয় যাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সেই ঝুঁকি মোকাবিলায় যথেষ্ট কার্যকর নয়। অর্থাৎ, দুর্যোগ-তাড়িত মানুষের ভোগান্তি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নির্মিত।

করোনাভাইরাসের আক্রমণ সকল স্থানে, সমাজে ও মানুষের উপর সমানভাবে প্রভাব রাখবে না। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের জরুরী উদ্যেগের প্রভাবও শ্রেণীভেদে অসমান প্রভাব রাখবে। আমার শ্রেণী অবস্থানকে একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক। আমি একটি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে আমার অর্থনৈতিক আয় বা বেতনের উপর বিন্দুমাত্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।

কিন্তু, যারা বিশ^বিদ্যালয়ের সীমার ভিতরে ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে, রিকশা চালিয়ে ও ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রাখার সরকারি ঘোষণাটি ভুল হয়েছে। বরং, এই বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে বলতে চাই যে, দুর্যোগের প্রভাব অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীভেদে এক নয়। দুর্যোগ নৃবিজ্ঞানী সুসানা হফম্যান বলেন, “দুর্যোগ হচ্ছে প্রকাশকারী। এটি প্রকাশ করে যে সমাজে নীরবে কি চলছে এবং তা কাকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন করছে”। অন্যভাবে বলেলে, দুর্যোগ আসার আগেই সমাজে বৈষম্য ছিল ও বিরাজমান আছে যা নির্ধারণ করে দেয় যে নিম্ন আয়ের মানুষ দুর্যোগকালীন সময়ে বেশি মাত্রায় ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।

করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি যেন না ঘটে সেজন্য বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মানুষের ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলোকে সীমিত করা হয়েছে। ফলস্বরুপ, দিনমজুররা ঘরের বাইরে বের হতে পারছেনা; কাজ করতে পারছেনা ও মজুরি পাচ্ছেনা। এতে করে, তাদের মতো মানুষদেরকে দুই ধরণের সংগ্রাম করতে হচ্ছে- ১. করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ও ২. দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে। আর, আমার মতো ও আমার চাইতেও উচ্চ শ্রেণীর ব্যক্তিরা শুধুমাত্র অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্য-ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে (যেমন- ভাইরাসমুক্ত বা জীবাণুমক্ত থাকার জন্য মুখোশ পরিধান করা ও ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধৌত করা)। উচ্চ শ্রেণী তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য খুব সহজে মাথাপিছু ডজনখানেক সাবান ক্রয় করার ক্ষমতা রাখে।

অন্যদিকে, বস্তিবাসী বা দিন আনে দিন খায় এমন পরিবারগুলির জন্য অতিরিক্ত সাবান কেনা একধরণের অর্থনৈতিক চাপ হিসেবে দেখা দেয়। তাছাড়া, প্রাকৃতিক সম্পদ তথা বিশুদ্ধ পানিতে নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রবেশাধিকার কাঠামোগতভাবেই সীমিত।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছু বাস্তবিক পদক্ষেপ নিতে হয় যা আপাতদৃষ্টিতে অনাকাক্সিক্ষত হলেও ব্যবহারিক দিকে থেকে সেগুলো ফলপ্রসূ। যেমনঃ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া মুখোশ পরিধান না করে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার জন্য সরকারি আদেশ রয়েছে। যে কোন সরকারি আদেশের ক্ষেত্রে নৃবিজ্ঞান জ্ঞানকান্ড জোরারোপ করে যে কিরূপ যোগাযোগ মাধ্যমে ও শব্দমালায় তা পরিবেশিত হচ্ছে। যেমনঃ নির্দেশ পরিবেশনকারী মাধ্যম রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র সাধারণত শুদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ব্যতীত কতজন মানুষ এই সকল মাধ্যমগুলোর সাথে দৈনন্দিন জীবনে অভ্যস্থ? প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে দেখা যায় যে পাবলিক স্থান, যেমন, বাজার, বাস স্ট্যান্ড ও ঘাটে স্থানীয় মানুষজন (বিশেষ করে, পুরুষরা) চায়ের দোকানগুলিতে বসে টিভিতে খবর দেখে। তাদের জন্য, সেই স্থানগুলোই হচ্ছে জরুরী তথ্য ও সরকারি আদেশ পাওয়ার জনপ্রিয় ও সহজ উপায়। বিবেচনায় আনতে হবে যে, দরিদ্র মানুষগুলোর ঘরে সংবাদমাধ্যগুলো নেই, তা ক্রয়ের সামর্থ্য তাদের নেই।

এছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক ভাষার চেয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সংস্কৃতি প্রবল। তাই, বেশি মানুষের কাছে জরুরী আদেশ ও তথ্য পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় মাধ্যম (যেমন, মাইক) আঞ্চলিক শব্দ (যেমন, লোকসঙ্গীত) ও সহজবোধ্য চিত্রের ব্যবহারকে বিবেচনায় আনা জরুরী । এতে, প্রত্যাশিত ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনা বাড়ে।

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো ও আমলাতন্ত্র কতখানি মানবিকতা, দক্ষতা, ধৈর্য্য, সৃজনশীলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে দুর্যোগে সাড়া দেয়, তা জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। প্রশাসনিক কাঠামোগুলি নিঃসন্দেহে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও কর্র্র্তৃত্ব অনুশীলন করে। কিন্তু, দুর্যোগের সময় বিপদাপন্ন মানুষ আশা করে যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনমূহ নমনীয়, দক্ষ, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিবে। প্রশাসনসমূহের উচিত হবে নৃবিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বিবেচনায় আনা।

নৃবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখান যে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে মানুষের মনে, সংস্কৃতিতে, সমাজে, ব্যক্তি জীবনে কি কি ধরণের পরিবর্তন আসে। দুর্যোগকালীন হতাশা ও উদ্বিগ্নতা মানুষের স্বাভাবিক আচরণে ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়াও, দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী রাষ্ট্র থেকে তৎক্ষণাৎ সেবা পেতে চায়, কারণ তাদের ইন্স্যুরেন্স কিংবা সঞ্চয় করার সামর্থ্য নেই। দুর্যোগের পরিস্থিতিতে তারা সাধারণত সামাজিক পুঁজি (আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কাল্পনিক আত্মীয়)-র উপর ভরসা করে। এরূপ জটিল পরিস্থিতিতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির উচিৎ হবে বিপদাপন্ন মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা।

পুলিশের লাঠির আঘাত কিংবা অপমানজনক আচরণ (যেমনঃ কান ধরে উঠা-বসা)- র মাধ্যমে জনগনের চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ রাখার পদ্ধতি কাম্য নয়। তা, প্রশাসনের উপর জনসাধারণের আস্থাকে কমিয়ে দেয়। এরূপ আচরণ বিপদাপন্ন মানুষকে আরও অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। যা মানবাধিকার পরিপন্থী। প্রশাসনের উচিৎ হবে করোনাভাইরাস দুর্যোগ পরিস্থিতিকে উন্নয়নের জন্য মানুষে স্থানীয় স্বাস্থ্য-চর্চা ও স্বাস্থ্য-জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তাদেরকে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা। সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতীত এ ধরণের দুর্যোগ মোকাবিলা করা সত্যিই কষ্টসাধ্য হবে।

দুর্যোগের ফলাফলগুলিকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। ১. কিছু প্রভাব সৃষ্ট হয় দ্রুত গতিতে। যেমন, বন্যার কারণে ঘর-বাড়ি ও জমির ক্ষয়ক্ষতি, নদী ভাঙনের কারণে জমি নদীর তলদেশে চলে যাওয়া, এবং সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের কারণে সর্দি-কাশি কিংবা মৃত্যু। ২. কিছু প্রভাব সৃষ্ট হয় ধীর গতিতে এবং সেগুলির ফলাফল প্রকৃতভাবেই জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী। যেমন, একটি স্বচ্ছল পরিবার দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে করতে অস্বচ্ছল হয়ে যেতে পারে; জোরপূর্বক কিংবা স্বেচ্ছায় সমাজচ্যুত হতে পারে কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে।

এরুপ পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত দেখতে পাই যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ করে। এটি আপাতদৃষ্টিতে সরল উপায় হলেও বাস্তবে তা নয়। যেমন, নৃবিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে। কে ত্রাণ দিচ্ছে? ত্রাণের উৎসসমূহ কি কি? ত্রাণ বিতরণে শুধুই কি পরার্থপরতা জড়িত নাকি এটির সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তারা কি তাদের খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য দিচ্ছেন? ত্রাণ কাজে ব্যবহৃত সম্পদ (অর্থ, খাদ্য, ঔষুধ) কি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? ত্রাণ বা সেবা বিতরণে স্বজনপ্রীতি কতখানি? স্বজনপ্রীতি যদি হয়ে থাকে, তাহলে তা কতখানি রাজনৈতিক ও কতখানি জ্ঞাতিম্পর্কীয়? নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রচুর অর্থ বিবিধ ধরণের ত্রাণ তহবিলে জমা হবে।

সে অর্থ কিরূপে ব্যবহার করা হবে তা নির্ধারণে নিশ্চয়ই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে এবং বিবিধ ধরণের বিশেষজ্ঞ (যেমন, অর্থনীতিবিদ, হিসাবরক্ষক, পরিসংখ্যানবিদ, চিকিৎসক) নিয়োগ দেয়া হবে। যেহেতু, ত্রাণ ও সেবা সামগ্রী জনগোষ্ঠীর সমাজের মানুষের কাছে পৌঁছানোই এরূপ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য, তাই মানুষ নিয়ে যাঁরা অধ্যয়ন করে (যেমন, নৃবিজ্ঞানী), তাদেরকে এই ধরণের পরিকল্পনা দলে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

নৃবিজ্ঞানীদের একাডেমিক প্রশিক্ষণ রয়েছে যে কিভাবে সেবা ও সামগ্রী বৈষম্যহীনভাবে সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে কার্যকরিভাবে বিতরণ করা যায়। সময় এসেছে মানুষের বিপদাপন্নতাকে গভীরভাবে ও ক্রিটিক্যালি বোঝা। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ক্যানন বলেন যে সাধারণত মানুষের বিপদাপন্নতাকে এড়িয়ে চলা হয় এই পূর্বানুমানের ভিত্তিতে যে এই দুর্যোগ-তাড়িত ভোগান্তিগুলি “বিজ্ঞানের সাথে অপ্রাসঙ্গিক” অথবা “এগুলি নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন”।

প্রায়ই দেখা যায় যে ত্রাণ বিতরণকারী কোন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে এবং তাকে ঘিরে বহুজন ছবি তুলে তা পত্রিকায় ও সামাজিক ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা হয়নি যে সাহায্য গ্রহণের ছবি তুলতে সাহায্য গ্রহণকারীরর সম্মতি আছে কি নেই। সাহায্য গ্রহণকারীর কাছে এটি অমর্যাদাকরও হতে পারে, সেটি খেয়াল রাখা জরুরী। বলা বাহুল্য, ব্যক্তির মান-মর্যাদা ও আত্ম-সম্মান সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মিত ও চর্চিত।

এতে একটি বিষয় প্রমাণ হয় যে সাধারণত সাহায্য গ্রহণকারী গরীব এবং তাদের মান-মর্যাদার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না। তাদের কন্ঠস্বর পলিসি পর্যায়েও অনুপস্থিত। এটি যে বহুদিন ধরে ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত হয়ে এসেছে তা মনে রাখা জরুরী। এরূপ নির্মাণের অবসান অবশ্যই হওয়া উচিৎ। এতে, দুর্যোগ পরববর্তী বৈষম্য ও ত্রাণ বিতরণকারীদের অসমীচীন আচরণ দূর হবে।

বিশ্বে করোনাভাইরাসের বিস্তৃতি বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (০১ এপ্রিল ২০২০) করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ৪৪ হাজার ১৫৫ জন এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৮ লক্ষ ৮৩ হাজার ২২৫ জন। প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশেও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৫০ জনের অধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে। এটি অনুমান করা যায় যে, ঘনবসতিপূর্ণ এই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে পারে।

সরকার বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনসাধারণকে অযথা রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে অনাগ্রহী করছে। চিকিৎসকরা নিজ স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সেবা দিচ্ছে। মানবাধিকারী কর্মীরা গরীবদেরকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। যেহেতু এই ভাইরাস মানুষের জীবনে দুর্যোগ নিয়ে এসেছে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তথা সমাজিক জীবনে ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে তাই এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক বিজ্ঞানীদের বিশেষ করে নৃবিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগানো যেতে পারে।


লেখক: মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়