মেধাবিদের আকর্ষণের বাইরে চলে যাচ্ছে শিক্ষকতা পেশা

মেধাবিদের আকর্ষণের বাইরে চলে যাচ্ছে শিক্ষকতা পেশা

ক্যাম্পাস টুডে ডেস্ক

দেশে মেধাবীদের সর্বোচ্চ চাকরি বিসিএস। বিসিএসের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডার প্রথম পছন্দ দিয়েছেন—এমন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

দেখা গেছে, প্রার্থীরা শেষ পছন্দ হিসেবে শিক্ষা ক্যাডার দিয়ে থাকেন। ফলে যাঁরা এখন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করছেন, তাঁরা অন্য কোনো ক্যাডারে উত্তীর্ণ হতে না পেরেই শিক্ষকতায় এসেছেন।

সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। অন্য কোনো চাকরি না পেয়েই তাঁদের বেশির ভাগ শিক্ষকতায় আসছেন। তবে এর সমান্তরালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবীরা এলেও বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত থাকছেন না।

এই অবস্থায় আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২০। বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করছে। এ বছর ইউনেসকো দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে ‘শিক্ষক : সংকটে নেতৃত্ব, নতুন করে ভবিষ্যতের ভাবনা’।

মেধাবীরা কেন শিক্ষকতায় আসছেন না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দেশে শিক্ষকতা পেশা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। এমনকি বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আগের চেয়ে বাড়লেও মর্যাদায় এগোচ্ছে না। প্রাথমিকের শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, যা বিশ্বেই বিরল।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১০ বছরেও। ফলে শিক্ষকরাও নিজ পেশায় মনোযোগ না দিয়ে অন্যান্য কাজে ঝুঁকে পড়ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভালো জাতি তৈরি করতে ভালো শিক্ষক দরকার। এ জন্য আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবার আগে নজর দিতে হবে। সেখানে মেধাবী শিক্ষক দরকার। মেধাবীদের প্রাথমিকের শিক্ষকতায় আনতে হলে ভালো বেতন দিতে হবে। তাঁরা যাতে দুশ্চিন্তামুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও মেধাবীদের আনতে হবে। এ জন্য যোগ্য লোককে উপযুক্ত বেতন দিতে হবে। আমাদের শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনো কম, এটাই বড় সমস্যা।

কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। তবে বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। তাঁদের শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে।

ভারতে সহকারী অধ্যাপকদের বেতন স্কেল ৫৫ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের এক লাখ ১০ হাজার টাকা। পাকিস্তানে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন এক লাখ চার হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শ্রীলঙ্কায় সহকারী অধ্যাপকের বেতন স্কেল এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা। নেপালে প্রভাষকের বেতন স্কেল ২৮ হাজার টাকা আর অধ্যাপকের ৬৫ হাজার টাকা।

এর বাইরে আবাসন, যাতায়াতের জন্য গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আর উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর শিক্ষকদের বেতন আরো কয়েক গুণ বেশি।

ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১৪ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষকের মধ্যে কর্মরত ১১ হাজার ১২৩ জন। ২৪ শতাংশ শিক্ষকই শিক্ষাছুটিতে ছিলেন, যাঁদের অনেকেই বিদেশে গিয়ে আর ফিরছেন না। আবার কেউ কেউ দেশে ফিরে কিছুদিন থেকে আবার বিদেশে চলে যাচ্ছেন।

দেশে ৬৫ হাজার ৬২০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় চার লাখ। তাঁদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখ সহকারী শিক্ষক এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। সম্প্রতি তাঁদের ১৩তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। এই গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে শিক্ষকরা বেতন পাবেন সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা।

আর প্রধান শিক্ষকদের সম্প্রতি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও এখনো তাঁরা সমপদের বেতন-ভাতা পাননি। তাঁরা ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনে সাকল্যে বেতন পাবেন ২১ হাজার ৫০০ টাকা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বেসরকারি। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীকে মূল বেতন দেয় সরকার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন। যেসব শিক্ষকের বিএড নেই তাঁরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতন পান। এর বাইরে তাঁরা সামান্য বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা পান।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘আমরা মূল বেতনের বাইরে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পাই। ২৫ শতাংশ ঈদ বোনাস পাই, যা দীর্ঘ ১৬ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। মুজিববর্ষেই শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের একমাত্র দাবি।’

দেশে সাড়ে ছয় হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, অনার্স-মাস্টার্স কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না। দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা এমপিওভুক্তির দাবি করে আসছেন।

প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের ছয় লাখ শিক্ষকও চরম অবহেলিত। করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষকের বেতন মার্চ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। অনেকেই এরই মধ্যে পেশা বদল করেছেন। বেশির ভাগই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *