জাপান সাকুরা প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষে দেশে ফেরত এলো বশেমুরবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা

মোঃ সুজন আলী


উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থ্যার সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে জাপানের সুনামধন্য অকায়েমা বিশ্ববিদ্যালয়ের (Okayama University) এর সাথে সহযোগিতা চুক্তি সই হয়েছিলো প্রায় ১বছর আগে । আর এর পেছনে যে মানুষটির ভূমিকা (অবদান) সবচেয়ে বেশি তিনি আমাদের প্রিয় সহকর্মী জনাব আবদুল্লাহ – আল আসাদ স্যার ।

আসাদ স্যার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড টেলিকমনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক, বর্তমানে অকায়েমা বিশ্ববিদ্যালয়ে PhD প্রোগ্রামে রয়েছেন। আসাদ স্যারের জন্য অনেক অনেক শুভ- কামনা রইলো তিনি যেন সফলভাবে PhD প্রোগ্রাম শেষে দেশে ফেরত আসেন । সেই সাথে এই চুক্তির সাথে সংযুক্ত সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই ।

চুক্তি অনুসারে জাপান সরকারের জাপান সায়েন্স এন্ড টেকনলোজি (JST Scholarship) এর আওতায় আমরা জাপান যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলাম । প্রাথমিকভাবে জাপান সাকুরা প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চার জন ছাত্র – ছাত্রী কে বাছাই করা হয়েছিল ।

সি ই সি বিভাগের মোঃ হাফিজুর রহমান (সেশন ২০১৪ – ২০১৫), ই ই ই বিভাগের নিলয় খান (সেশন ২০১৪ – ২০১৫), ই টি ই বিভাগের সোনিয়া আক্তার (সেশন ২০১৪ – ২০১৫) এবং ই টি ই বিভাগের রিতা রানী বিশ্বাস (সেশন ২০১৩ – ২০১৪) । কিন্তু সি ই সি এবং ই ই ই বিভাগে এম. এসসি. কোর্স চালু না থাকায় আমাদের প্রথম দুইজন ছাত্র বাদ পরে যায় । মোঃ হাফিজুর রহমান এবং নিলয় খান এর জন্য শুভ – কামনা রইলো তারা ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করবে এই আশা রাখি ।

পরবর্তীতে ই টি ই বিভাগের বেনজির হুসাইন (সেশন ২০১৪ – ২০১৫) এবং ই টি ই বিভাগের প্রসেঞ্জিত দত্ত (সেশন ২০১৩ – ২০১৪) এই গ্রুপে সংযুক্ত হয়। আর এই চার জন ছাত্র – ছাত্রী কে সবদিক দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য আমাকে (মোঃ সুজন আলী, সহকারী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ) সংযুক্ত করায় সেনসেই কে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।

ইতোমধ্যে, জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি আমার প্রান প্রিয় চার জন ছাত্র – ছাত্রী কে সাথে নিয়ে ভিসা সংক্রান্ত সকল কাজ শেষ করলাম । পরেরদিন আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে এলাম । এরপর আমাদের অপেক্ষার পালা শুরু হল ।

অবশেষে ১৫ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ ঢাকায় পৌঁছানোর পর সবাই প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ( বিশেষ করে টাকা ইয়েনে পরিবর্তন, কেনাকাটা ইত্যাদি ) গন্তব্যে ফিরে গেলাম । ১৬ ই ফেব্রুয়ারী ( বেলা ১২ টা ৩০ মিনিটে আমাদের যাত্রা শুরুর উদ্দেশ্যে ) হযরত শাহাজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ পোঁছালাম । অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ১৭ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ পৃথিবীর অন্যতম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট জাপানের কানসায় এয়ারপোর্ট এ হাজির হয়েছিলাম। এই লম্বা সফরে সার্বিক সহযোগিতায় আসাদ স্যারের অবদান অনস্বীকার্য ।

১৭ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ থেকে ২৩ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ এই সাতদিন আমরা জাপানে ছিলাম। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় আমাদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে বিকাল ৫ টায় শেষ হতো । প্রথম দিন (১৮ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০)সেনসেয় অকায়েমা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পরিবেশ, একাডেমিক কার্যক্রম, মাস্টার্স এবং পি এস ডি (PhD) প্রোগ্রাম সহ নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা রাখলেন। ক্লাশ রুম, ল্যাব রুম সহ আনুসাঙ্গিক সব কিছু দেখে আমি আর আমার ছাত্র- ছাত্রীরা শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এরই ফাঁকে ল্যাবে জাপানিজ ছাত্র – ছাত্রীদের সাথে পরিচিত হলাম।

বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। জাপানিজ ছাত্ররা সেনসেয় (Professor) এর ল্যাবে কি ধরনের কাজ হয় সেই বিষয়ে আমাদেরকে অনেক কিছু জানালো। সেনসেয় এর ল্যাবটি এক কথায় অসাধারন!!! প্রতিটি ল্যাবই যেন আধুনিক প্রযুক্তির সমাহার ।

সব কিছু দেখে মনে হল এখানে থেওরি আর ল্যাবের এক দারুণ রসায়ন কাজ করছে , নতুন কিছু করার জন্য এরা মুখিয়ে আছে। আর এই প্রযুক্তির প্রসারে জাপান সরকার অগ্রণী ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে । জাপানে থাকাকালীন অটো, বাস এবং ট্রেন ( বিশেষ করে বুলেট ট্রেন, ঘণ্টায় ৩০০ কি. মি. ) সার্ভিস দেখে আমাদের কাছে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে জাপান পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর দেশ।

অকামাতে হাঁটার সময় কোন একজন বলেছিল এটা জাপানের একটা গ্রাম । আমাদের মনে হয়েছিলো এটা যদি গ্রাম হয় তাহলে জাপানের অন্য শহর গুলোর কি অবস্থ্যা ??? এই গ্রামের মত একটি শহর ও আমাদের দেশে নেই । চারিদিকে শুধু বড় বড় স্থাপনা, বহুতলা ভবনগুলোর দিকে তাকালে শুধু প্রযুক্তির ছোঁয়া চোখে পড়ে ।

আসলে, জাপান সরকার জাপানের প্রতিটি জায়গায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছুঁয়া পোঁছে দিয়েছে । জাপান সরকার বিভিন্ন দেশের সেরা মেধাবীদের এখানে আসার সুযোগ করে দিয়েছে এবং দিচ্ছে । এই সব মেধাবীদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক সব ল্যাবে নতুন নতুন উদ্ভাবন চলছে। আর এইভাবেই প্রযুক্তি নির্ভর জাপান আরও বেশি এগিয়ে যাচ্ছে, নিজেদের অবস্থান কে উন্নত করছে উন্নত দেশের উচ্চ আসনে ।

১৯ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ থেকে ২০ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ পর্যন্ত আমি এবং আমার ছাত্র- ছাত্রীরা অনেক গুলো ল্যাব দেখেছিলাম। সেনসেয় দের নামে পরিচিত এই সকল ল্যাবে নানা ধরনের গবেষণা (রিসার্চ) হয়। নতুন নতুন গবেষণা সৃষ্টিই এই সকল ল্যাবের মূল কাজ। প্রত্যেক সেনসেয় তাদের ল্যাব সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রেখেছিলেন।

ল্যাবের আধুনিক সব যন্ত্রপাতি আমাদেরকে দেখালেন এবং কোন যন্ত্রে কি ধরণের কাজ হয় সব কিছু আমাদের কে বুঝাইয়া দিচ্ছিলেন। আর এই সকল্ কাজে আসাদ ভাই সহ বাংলাদেশী বড় ভাইয়েরা (রাজিব ভাই, ফিরোজ ভাই সহ অনেকে ) অনেক সহযোগিতা করেছিলেন। জাপানে PhD চলমান এই সকল ভাইদেরকে (সার্বিক সহযোগিতার) অসংখ্য ধন্যবাদ।

এই তিন দিনে আমরা অনেক কিছু জানলাম এবং শেখার চেষ্টা করলাম। আর সেনসেয় এই সব কিছু মনিটরিং করছিলেন। প্রতিদিনের ( সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত ) প্রোগ্রাম শেষে সন্ধ্যার পর আসাদ ভাই এবং হান্নান ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন শপিং মলে কেনাকাটা করতে যাওয়া এবং রাতে ইন্দিয়ানা – নেপালি হোটেলে খাওয়ার কথা কখনোই ভুলবার নই । ল্যাব দেখার পাশাপাশি সেনসেয় আমাদের গ্রুপকে কিছু সফটওয়্যার সংক্রান্ত কাজ দিয়েছিলেন।

২১ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ শুক্রবার সকাল ১০ টায় এসে তিনি আমাদেরকে বেলা ২ টায় রিপোর্ট প্রেজেন্টেশন এর কথা বলে গেলেন। পূর্বেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু হলেও আমাদের হাতে খুব বেশি ডাটা ছিল না। তারপর ও গ্রুপ মেম্বার সবাই মিলে কোন রকমে একটা প্রেজেন্টেশন তৈরি করলাম।

শুক্রবার জুমার নামাজ থাকায় এই ক্ষেত্রে প্রসেঞ্জিত কে অগ্রণী ভূমিকায় থাকতে হয়েছিল। আমরা সবাই মিলে মোটামুটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম। প্রেজেন্টেশন শেষে সেনসেয় সাকুরা সায়েন্স এর অবদানের কথা তুলে ধরলেন এবং আমাদের সবাই কে সাকুরা সায়েন্স এর পক্ষ হতে এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করলেন।

শেষ বেলায় আসাদ স্যার ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের বাংলা ভাষা (International Mother Language Day) এর উপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা রেখেছিলেন। সর্বোপরি, সাকুরা প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষ করার জন্য আমার গ্রুপ মেম্বার, আসাদ স্যার, সেনসেয় এবং ল্যাবের সকল ছাত্রদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই। বিকাল ৫ টার পর সেনসেয় আমাদেরকে অকায়েমা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী ঘুরে দেখালেন। এক কথায় অসাধারণ!!! আধুনিক সিস্টেমে পরিচালিত এই লাইব্রেরী আমাদের চোখে অন্যতম সেরা লাইব্রেরী হিসাবে প্রতিয়মান হয়েছিলো।

সেনসেয় জাপানের নোবেল প্রাপ্ত ব্যাক্তিদের নিয়ে অনেক কথা বললেন । সন্ধ্যায় সেনসেয় ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন । সেখানে অনেক সময় আমাদের সাথে সেনসেয় গ্রুপ মেম্বারদের আড্ডা, বাংলাদেশ এবং জাপানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা চলেছিল । সেনসেয় এর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে পেরে আমরা সত্যিই গর্ব অনুভব করছিলাম।

২২ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ বেলা ৪ টায় আমাদের অকায়ামা ত্যাগ করার দিন ছিল। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল ১০ টায় Kurakuen Garden and Okayama Jo – Castle দেখার উদ্দেশ্যে আমরা সবাই ঘুরাঘুরির জন্য বের হলাম । কিন্তু বৃষ্টি আমাদের যাত্রাকে রুখে দিলো । পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে BIC CAMERA and AYON MALL দেখার জন্য রওয়ানা দিলাম। সেনসেয় আগে থেকেই AYON MALL এ অপেক্ষা করছিলেন। আমরা পোঁছালে সবাই মিলে ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং অনেক কেনাকাটা করলাম ।

বলে রাখা ভালো যে, আমাদের দেশে ঢাকা শহরে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স এবং যমুনা ফিউচার পার্ক এই সব শপিং মলের কাছে নিতান্তই ছোট । জাপান সরকার কেনাকাটা সহ অনান্য খরচ বাবদ আমাদের প্রত্যেকে ৯৫ হাজার ইয়েন দিয়েছিল। এই ইয়েন দিয়ে BIC CAMERA থেকে কেউ কেউ আই প্যাড, হাত ঘড়ি (জাপানিজ), আবার কেউ কী আই ফোন কিনে নিলো।

কেনাকাটা শেষে সেনসেয় আমাদের সাথে দুপুরের খাবার খেলেন। খাবার শেষে সেনসেয় এর কাছ থেকে সবাই বিদায় নিলাম এবং হোটেলে ফিরে গেলাম। বিকাল ৫ টায় জাপানের কানসায় এর উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম । রাত্রে কানসায় হোটেলে ফিরে আসাদ স্যারকে বিদায় দিলাম। বাংলাদেশে ফেরত আসার উদ্দেশ্যে কানসায় এয়ারপোর্ট (বেলা ৯ টা ৩০ মিনিটে বিমান ) এ রওয়ানা দিলাম ।

বিমানে লম্বা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ২৩ ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০ রাত ১১ টা ৩০ মিনিটে আল্লাহ এর রহমতে শাহাজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ পোঁছালাম। ফেরার পথে সবার চোখে ছিল নতুন নতুন স্বপ্ন, নিজেকে নতুন ভাবে তৈরি করার দিঢ় প্রত্যয় ।

উল্লেখ্য যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র ইতোমধ্যে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে অবস্থান করতেছে । আমার জানামতে, জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে এটাই ছিল বশেমুরবিপ্রবি ছাত্র – ছাত্রীদের প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া । আগামী দিনে এই ধারা অব্যাহত থাকুক এই শুভ – কামনা সব সময় থাকবে । নতুন নতুন জ্ঞান আর চিন্তা – ভাবনায় বেড়ে উঠুক আমাদের প্রাণের ছাত্র – ছাত্রীরা ।

তাদের অর্জিত জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের এই ৫৫ একরের প্রতিটি কোনায় কোনায়, বশেমুরবিপ্রবি এমন সব খবরের মাধ্যমে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকুক বিশ্ব দরবারে এই আমাদের সবার মনের আশা । এমনটি হলেই এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পাবে তার আসল পরিচয় । আর এই বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা করতে পারবে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের সার্থকতা এই আমার বিশ্বাস।

পরিশেষে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় খরচ (এয়ারফেয়ার টিকেট, হোটেলে থাকা, খাওয়া – দাওয়া ইত্যাদি ) বহন করার জন্য জাপান সরকার (Japan Science and Technology Agency) কে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই । সেই সাথে ধন্যবাদ জানাই সেনসেয় কে সব কিছু সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য । আর এই ভাবেই জাপান সাকুরা প্রোগ্রাম সফলভাবে শেষ করে বশেমুরবিপ্রবিতে ফিরে এলাম আমরা।


মোঃ সুজন আলী
সহকারী অধ্যাপক
গণিত বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ, বাংলাদেশ ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টুঙ্গিপাড়ার একটি সাধারণ শিশু থেকে কী করে একটি জাতির মুক্তির প্রধান দিশারী হয়ে উঠলেন, চলুন জানা যাক তার জীবনের সেই ধাপগুলো।

শেখ মুজিবুর রহমানঃ

(১৭ মার্চ১৯২০ – ১৫আগস্ট ১৯৭৫), সংক্ষিপ্তাকারে শেখ মুজিব বা মুজিব, ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি বাঙালির অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের “জাতির জনক” বা “জাতির পিতা” বলা হয়ে থাকে। তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং শেখ সাহেব হিসাবে বেশি পরিচিত ছিলেন এবং তার উপাধি “বঙ্গবন্ধু”। তার কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

জন্ম ও শিক্ষাঃ

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন এবং মা’র নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোনের নাম ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেন নি। কারণ তার চোখে জটিল রোগের কারণে সার্জারি করাতে হয়েছিল এবং এ থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।

বাংলা ভাষা আন্দোলনঃ

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে। ১৯৪৮ সনের ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই মন্তব্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদী শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলিম লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। এই বছরের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয় যাতে শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। এদের মুক্তি উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় র‌্যালি হয় যাতে মুজিব সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ এই র‌্যালি অবরোধ করেছিল। পুলিশী কার্যক্রমের প্রতিবাদে শেখ মুজিব অবিলম্বে ১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। এতে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে তাকে আবার আটক করা হয় এবং বহিষ্কৃত হন। উল্লেখ্য যে ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট তার হৃত ছাত্রত্ব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ফিরিয়ে দেয়া হয়।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন যার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু তিনি এই জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা প্রদান থেকে বিরত থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হক টাঙ্গাইলে একটি উপ-নির্বাচনে বিজয় লাভ করেন। শেখ মুজিব তার সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের ধর্মঘট করেন যার জন্য তাকে আবার আটক করা হয়। এ সময়ই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাঃ

২৩ জুন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাকে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। জুনের শেষ দিকে জেল থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পরই খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেন। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে সাময়িকভাবে আটক করে রাখা হলেও অচিরেই ছাড়া পেয়ে যান। এর পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে মিলে লিয়াকত আলি খানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের চেষ্টা করায় ভাসানী এবং তাকে আটক করা হয়। এটি ছিল অক্টোবরের শেষদিকের কথা।

১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এবারও শেখ মুজিব আটক হন। সেবার তার দুই বছর জেল হয়েছিল। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ঘোষণার পর জেলে থাকা সত্ত্বেও জেল থেকে নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে তিনি ভূমিকা রাখেন। এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই সময়ে শেখ মুজিব জেলে থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তার এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি

৬ দফা

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বৈঠকের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিব তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মহাসচিব ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ ১৯৬৪ একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় যার মাধ্যমে মুজিব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, রাজনীতির নামে মৌলিক গণতন্ত্র প্রচলন (বেসিক ডেমোক্রেসি) এবং পাকিস্তানের কাঠামোতে এক-ইউনিট পদ্ধতির বিরোধী নেতাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিব। এই পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং প্রদেশগুলোকে একত্রে জুড়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কাজ করতে গিয়ে মুজিব আইয়ুব-বিরোধী সর্বদলীয় প্রার্থী ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন। যথারীতি নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পূর্বে তাকে আটক করা হয়। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং আপত্তিকর প্রস্তাব পেশের অভিযোগে অভিযুক্ত করত এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্য উচ্চ আদালতের এক রায়ে তার আগেই তিনি মুক্তি পেয়ে যান। এ সময় সামরিক বাহিনীর গণহত্যা আর বাঙালিদের চাহিদা পূরণে সামরিক শাসকদের ঔদাসীন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। শেখ মুজিব এই দাবিকে আমাদের বাঁচার দাবী শিরোনামে প্রচার করেছিলেন। এই দাবির মূল বিষয় ছিল একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানী ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এই দাবি সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ কারণে তিনি উক্ত সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন। প্রায় পুরো দেশই ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় তিনি সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে বন্দী হন। বছরের প্রথম চতুর্থাংশেই তাকে আটবার আটক করা হয়েছিল। এই বছরের মে ৮ তারিখে নারায়ণগঞ্জে পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র‍্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তার মুক্তির দাবিতে ৭ জুন দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ এই ধর্মঘট চলাকালে গুলিবর্ষণ করে যার কারণে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আনুমানিক তিনজনের মৃত্যু হয়।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতাঃ

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এর ফলে বুঝতে পারে যে, মুজিবের দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন।

ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ:

“এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।”

মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। পাকিস্তানি জেনারেল রহিমুদ্দিন খান মুজিবের মামলার পরিচালনা করেন। মামলার আসল কার্যপ্রণালী এবং রায় কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় নি। এ মামলাটি “লায়ালপুর ট্রায়াল” হিসাবে অভিহিত।

১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও অস্থায়ী সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অভিযান অল্প সময়ের মধ্যেই হিংস্রতা ও তীব্র রক্তপাতে রূপ নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে। বাঙালি ও অবাঙালি হিন্দুদেরকে লক্ষ্য করে বিশেষ অভিযানের কারণে সারা বছরজুড়ে প্রচুর হিন্দু জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেণ্টে কর্মরত পূর্ব বাংলার সদস্যবৃন্দ দ্রুত বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং লীগ সদস্যবৃন্দ কলকাতায় তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্ব বড় রকমের বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকার মুজিবকে ছেড়ে দিতে এবং তার সাথে সমঝোতা করতে অস্বীকৃতি জানায়।

যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তার সন্তান শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর ভিতরে সংঘটিত যুদ্ধটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সরকারের অংশগ্রহণের পর, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং লীগ নেতৃবৃন্দ ঢাকায় ফিরে সরকার গঠন করেন। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি দেন। এরপর তিনি লন্ডন হয়ে নতুন দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী’র সাথে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে “ভারতের জনগণ, আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে তাকে সাধুবাদ জানান। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে এসে তিনি সেদিন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।

জাতীয় শোক দিবস:
হত্যাকাণ্ড (শোকাবহ আগষ্ট)-

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতির ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের হত্যা করে। কেবল তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান। তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সামরিক কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন।

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়। যা ১২ অগাস্ট ১৯৯৬ তারিখে সংসদে রহিত করা হয়। সংবাদ মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ)-কে দায়ী করা হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন দিয়ে লরেন্স লিফসুল্জ সিআইএ-কে সামরিক অভ্যুত্থান ও গণহত্যার জন্য দোষারোপ করেন। তার মরদেহ তার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সামরিক তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়। অন্যান্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে বহু বছরের জন্য চলমান রাজনৈতিক সংঘাতের সূচনা ঘটে। সেনাঅভ্যুত্থানের নেতারা অল্পদিনের মধ্যে উচ্ছেদ হয়ে যান এবং অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে দেশে চলমান অচলাবস্থা তৈরি হয় এবং সেনাবাহিনীতে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর তৃতীয় সেনা অভ্যুত্থানের ফলশ্রতিতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসীন হয়। সেনাঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ১৪ জন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিরা বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে খুনি সৈয়দ ফারুক

আমার মুজিবঃ

‘মুজিব’ এটা কি কোনো নাম?
নাকি তিন অক্ষরের শব্দ! মনে হয়,
‘মু জি ব’ তিন অক্ষরের এমন একটি শব্দ – যে শব্দটি শুনলেই আবেগে চোখে পানি এবং শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা অবনত হয়ে আসে। আমার কাছে মুজিব হলো ত্যাগই মহাপুরুষ। জন্মের পরই হয়তো নদীমাতা তার স্রোতধারায় বলে দিয়েছিল,

“হে মুজিব তুমি আমাদের স্বাধীনতা বইতে দাও, আমাদেরকে সকল পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত কর।

আরও পড়ুনতারুণ্যের ভাবনা: বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ
তাইতো মধুমতির তীরে আবির্ভূত হওয়া মুজিব আঙ্কা পেয়েছিল poet of politics হিসেবে।
যে সকলের জন্য নিজের ব্যাক্তিগত চাহিদাকে হত্যা করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পারাটাই মহত্ত্ব মনে করতেন। তিনি তার ৫৪ বছরের জীবনে ৪৬৮২ দিন কারাবন্দী কাটিয়েছেন। যা ছিলো তার জীবনের এক – চতুর্থাংশ। মুজিব হলেন এক অসম্পূর্ণ মহাকাব্য। যার রচয়িতা যিনি নিজেই। ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ সেই মহাকাব্যের জন্ম। এই মহাকাব্যকে যদি বৃক্ষের সাথে তুলনা করা হয়, তবে ছয় দফা আন্দোলন তার মূল, ৭-ই মার্চের ভাষন তার কান্ড, ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষনায় ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ তার পাতা এবং ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় হলো তার ফুল। সে ফুলের নাম বাংলাদেশ। আর মুজিব ফুলের সুবাস। যার উপস্থিতি দেখা যায় না কিন্তু অনুপস্থিতি ফুলকে করে সুভাষিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট অসম্পূর্ণ অবস্থায় এই মহাকাব্য রচনা থামিয়ে দেয়া হয়। সেই থেকে এই মহাকাব্য অসম্পূর্ণ কিন্তু মনের মণিকোঠায় সদা মুজিব মহাকাব্য বিদ্যমান। আমার মুজিব তার বজ্রকন্ঠে পুরো বিশ্বে তার স্থান করে নিয়েছেন। শুধু একটা কথাই বলবো,

“মুজিব কোনো দলের না
ক্ষমতা বা বলের না।
মুজিব সমগ্র জাতির।
মুজিব আমার।

মুজিব আমার ভালোবাসার নাম। আমার প্রিয় কবির নাম, আরে তিনি তো কবিই! ৭ কোটি বাঙালিকে নিয়ে তিনিই তো বাংলাদেশ নামক জাগ্রত কবিতাটি লিখেছেন।আমার স্বপ্ন, আমার মুজিবের মতো একদিন আমিও বলবো, হ্যাঁ আমিও দৃঢ়কন্ঠে বলে উঠবো –

“চলো সব হানাহানি দূর্নীতি বন্ধ করি
শেখ মুজিবের সোনার বাংলা গড়ি।

আরও পড়ুন বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম চির অম্লান

লেখকঃ তাসফীর ইসলাম (ইমরান)

অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী

বা সা ই (রামমালা,কুমিল্লা)

বিঃ দ্রঃ- আমি ছোট মানুষ। বিশ্বনেতাকে নিয়ে লিখলে আমার কিছু ভুল হতেই পারে। তবুও তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’,গুগল,উইকিপিডিয়া, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনে স্মরণীয় ঘটনা’, আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’, ‘শেখ মুজিব ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি’ এবং অন্যন্য বই ও নথির সূত্র ধরে সেই ইতিহাস হাজির করার চেষ্টা করেছি। ভুল হলে মার্জিত করবেন।

তারুণ্যের ভাবনা: বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ

আবু জাফর আহমেদ মুকুল


আমার জন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় এক দশক পরে। বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখিনি। খুব বেশি জানার সুযোগও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার ছিল না। স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে ঠিক যেভাবে পাওয়ার কথা ছিল, সেভাবে কখনো পাইনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়া আমার প্রথম বই ‘মুজিবরের বাড়ি’।

সময়টা সম্ভবত ১৯৯৪ সালে আমি যখন ৬ষ্ট শ্রেনীতে পড়ি। সেই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লিখেছিলেন, ‘শত চেষ্টা করেও বাঙালির মন থেকে দুজন বাঙালির নাম মুছে ফেলা যাবে না। এমনই শক্তি ও দুটি নামের। এদের একজন হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি বাংলা ভাষাকে পরিচিত করেছিলেন বিশ্ব দরবারে। যাঁর গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আরেকজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। যাঁর নেতৃত্বে বাঙালি প্রথম আলাদা একটি ভূখণ্ড নির্মাণ করতে পেরেছিল।’

এ বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা-ডিআইটিএফ ২০২০ ঘুরে হঠাৎ দেখি একটি প্যাভিলিয়নে উপচেপড়া তরুণদের ভিড়। আমি ও আমার পরিবার একটু পথ এগিয়ে যেতে দেখি তরুণদের ভিড় সামলাতে ব্যস্ত স্বেচ্ছাসেবীগন। হয়তো ভাবতে পারেন এটি প্যাভিলনের কেনা-কাটার ভিড়। আসলে তরুণদের উপচে পড়া ভিড় ছিল বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নে।

পর্যবেক্ষণ করছিলাম মেলায় আসা অধিকাংশ তরুণ দর্শনার্থী প্যাভিলিয়নটি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের সঙ্গে ছবি তুলছেন। অনেকে আবার প্যাভিলিয়নের মধ্যে বই পড়ে সময় পার করছেন। মেলায় এসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পেরে আনন্দিত আমার এক শিক্ষার্থী স্বপ্না আক্তার বলেন- এখানে বঙ্গবন্ধুর কিছু দুর্লভ ছবি দেখে ভালো লেগেছে।

বিশেষ করে এ প্যাভিলিয়নে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে ভিডিও চিত্র দেখানো হয়েছে, তা আমার হৃদয় ছুঁয়েছে। কথাটি শুনে মন ভরে গেল এই ভেবে যে, সত্যিই তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে ধারন করতে চায়। বঙ্গবন্ধু কোন নির্দিষ্ট দলের নয়, বঙ্গবন্ধু সকলের। তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়নের প্রবেশ দ্বারেই ছিল বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ছিল আর্টিফিশিয়াল (কাঠের তৈরি) বই। যেখানে বঙ্গবন্ধুর নানা কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশে রয়েছে, সারিবদ্ধ একাধিক সেলফ, যেখানে সাজানো আছে জাতির পিতার ওপর লেখা নানা বই। মেলায় আগতরা যাতে বই পড়ে বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালো করে জানার জন্য রাখা হয়েছে টেবিলও।

পুরো প্যাভিলিয়নজুড়ে ছিল- বঙ্গবন্ধুর নানা উক্তি এবং তাকে নিয়ে নানা লেখা। প্যাভিলিয়নের পশ্চিম দেয়ালে ঠাঁই পেয়েছিল শেখ পরিবার। যেখানে আছে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের পারিবারিক ছবি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ নানা ধরনের দুর্লভ ছবি।
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও বাঙালি শব্দগুলো একই সূত্রে গাঁথা। বর্তমান তরুণ সমাজে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বঙ্গবন্ধুকে চেনে না। আর চিনবেই বা না কেন? তার মহান আত্মত্যাগের ফলেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের।

বঙ্গবন্ধুর যে দুটি বই এখন অনেক পাঠকের হাতে দেখতে পাই—অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা, সে দুটিতে তারুণ্যের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এবং তাঁর নিজের তরুণ জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে তিনি লিখে গেছেন। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, অভয় মানো—তিনি তরুণদের বলছেন; যেখানে অন্যায়, অবিচার সেখানে প্রতিবাদ করো; মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার এবং স্বার্থের ঘর বড় করে, তাদের প্রতিরোধ করো।

বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রায় বেশিরভাগ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়ে আমরা জানতে পেরেছি, তার চিন্তা-চেতনা ছিল তারুণ্যকেন্দ্রিক। সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও আবেগই পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদী রূপ ধারণ করে তার মন ও মননে সূচনা ঘটিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের।

বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, অধিকার পেতে হলে নীরব থাকলে চলবে না; সবাইকে জাগাতে হবে, তাদের মনে গেঁথে দিতে হবে স্বাধীনতার মন্ত্র।
বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে যে নামটি চিরস্মরণীয় ও উজ্জল নক্ষত্রের মতো চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।

বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন-‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
তরুণদের সঙ্গে একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তিনি তাঁদের সংগ্রামের বাণী দিতেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় উৎসাহিত করতেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন।

তরুণদের তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, অসত্য, অর্ধসত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে, বঞ্চনা-অনাচার এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে উদ্দীপনা জোগাতেন। তিনি চাইতেন বাঙালি তরুণ যুগের আদর্শগুলো ধরে রেখে বিশ্বমানব হোক। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটি ছাত্র আন্দোলন সারা দেশের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হয়, তরুণেরা বঙ্গবন্ধু থেকে প্রেরণা নিয়েছিল। নিরাপদ সড়কের দাবিতে যে আন্দোলন হলো, তাতেও শিক্ষার্থীরা পোস্টার লিখে জানাল, তারা প্রতিবাদী হওয়ার সাহস বঙ্গবন্ধু থেকে নিয়েছে। বর্তমান তরুণদের মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা থেকে শুরু করে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব দিন পর্যন্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন মো, শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবির উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার রেসকোর্স মাঠে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিলেন, দেশের মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার বার্তা দিলেন, তা সারা দেশে সব মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। তিনি উক্ত ভাষণ বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। উক্ত ভাষণ ১৮ মিনিট স্থায়ী হয়।

ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ডকুমেন্টারী হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

এজন্যই বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গেলে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর উক্তি সবার আগে মনে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে ক্যাস্ট্রো বলেন,‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।

আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। পেছন ফিরে আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখি আর তাঁর কথা শুনি। তাঁর কথাগুলো এখন তরুণেরা শুনছে, পড়ছে। তারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তারা যে বাংলাদেশ চায়, বঙ্গবন্ধুও সেই দেশটি চেয়েছিলেন এবং তার একটি বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, ‘সোনার বাংলা।’

বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন বাংলার মানুষ একতাবদ্ধভাবে থাকবে। সুন্দরভাবে হাসি-খুশিতে জীবনযাপন করবে। বর্তমান প্রজন্ম চেষ্টা করবে জাতির জনকের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিশ্বাস করতেন তরুণরাই দেশের মূল চালক। তাই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে এক হতে হবে এবং দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসা সার্থক হবে।

তথ্যসূত্রঃ দেশি ও বিদেশি বই-প্রবন্ধ, নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট ও পর্যবেক্ষণ।

লেখক: শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক, ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ, গবেষণায় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপ প্রাপ্ত এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ‘আগামীর বাংলাদেশ’।

বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম চির অম্লান

 

 

“যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই

তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।” বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাসে যেই শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তা কখনো পূরণ হবার নয়।

জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল ঘাতকের হাতে তার নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির ইতিহাসে এক বড় কলঙ্ক।

১৯৭৫ সালের শোকাবহ এই কালো দিবসে ভোররাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবনেতা ও সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু, কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।

একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে বছরের পর বছর এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ থাকা ছিল আইনের শাসনের পরিপন্থী। এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর অবদান মুছে ফেলার প্রক্রিয়াও নানাভাবে চালানো হয়েছে।

ইতিহাসে যার স্থান সুনির্দিষ্ট ও স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল, তাকে অস্বীকারের মূঢ়তা বিভিন্ন সরকারের আমলে কম দেখানো হয়নি। এতে করে স্বল্পকালীন সুবিধা হাসিল করা গেলেও চূড়ান্ত বিচারে তা সফল হয়নি। বরং মৃত বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন হয়ে উঠেছেন আরও শক্তিশালী। জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অবদানই তাকে অজেয় করে রেখেছে।

 

এর শুরু ১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে আমরা বাঙালিরা নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হবো।

দেশের স্থপতি ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে তার পরিবারের সদস্যসহ এমন ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশ ও জাতিকে বিপথগামী করার অপপ্রয়াস চালানো হয় পরবর্তীকালে।

হত্যাকারীদের বিচার থেকে রেহাই দিয়ে জারি করা হয় কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। সেই অধ্যাদেশ বাতিলের পর দেরিতে হলেও বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এ বছর ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জরিত এক জনকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। আর অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশে। অর এই পলাতক খুনিদের দেশে এনে তাদের শাস্তি কার্যকর করা সরকারের দায়িত্ব।

বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনে একটিই ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা ছিল বাংলা এবং বাংলার মানুষকে সৈরাশাসকের অত্যাচার এবং জুলুম থেকে মুক্ত করা। এই প্রচেষ্টার শুরু হয়েছিলো১৯৪৮ সাল থেকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয় বাঙ্গালির উপর জুলুম অত্যাচার শুরু হয়।

তাই এ থেকে জনগণের মুক্তির জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের পথ। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্র“য়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৫৬-এর শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৩-এর রবীন্দ চর্চা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়- প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর ছিল বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। বাংলাদেশ ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন কাম্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ ও জাতির সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে তার আপন মহিমায় প্রতিস্থাপন করা হলে জাতি হিসেবে সবাই গৌরবান্বিত হবে।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে জেল জুলুমআত্যাচার নির্যাতন আর স্বৈরাশাসকের ঘৃনার পাত্র ছিল বঙ্গব। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে আনেক বার। বহুবার ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য।বাঙালির প্রতি তার বিশ্বাস ভালোবাসা ও আস্থা ছিল আকাশচুম্বী।

আরও পড়ুনবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও রক্তস্নাত আগস্ট

বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সব ধরনের জুলুম আত্যাচার নির্যাতন বরণ করেছেন। তিনি আমাদের প্রগতিবাদী অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশে রূপান্তর করাই হবে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বোত্তম উপায়। পরিশেষে কবির ভাষায় বলতে চাই

“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”

লেখক

মোঃ রাইয়ান জিহাদ
শিক্ষার্থী – মোল্লাকান্দি লালমিয়া পাইলট হাই স্কুল এন্ড কলেজ, কুমিল্লা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও রক্তস্নাত আগস্ট

অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা


১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট নয়টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবন থেকে নিজ বাসভবন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে ফিরে আসেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। শেখ রাসেল তার পিতাকে অনেকের সাথে ফুল দিবে।

এ নিয়ে তার ভীষণ আনন্দ। রাত ৯টার পর তোফায়েল আহমেদ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বঙ্গবন্ধু সাধারণত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে ঘুমাতে যেতেন। প্রতিদিনের মত সেদিন রাতে তোফায়েল আহমেদদের বিদায় দিয়ে তিনি ঘুমাতে যান।

বঙ্গবন্ধুর বাসায় থাকতেন তাঁর পিএ জনাব মহিতুল ইসলাম। জনাব ইসলাম সেদিন রাতে দেড়টার দিকে ঘুমাতে যান। শেষ রাতের দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসার একজন কাজের লোক জনাব মহিতুল ইসলামকে ডেকে বলেন বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে কথা বলবেন। জনাব ইসলাম টেলিফোন ধরলে বঙ্গবন্ধু সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণ হয়েছে বলে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে বলেন।

বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় নিচে নেমে আসেন। মহিতুল ইসলামের টেলিফোন পুলিশ কন্ট্রোল রুম রিসিভ করেনি এবং বঙ্গভবনের এক্সচেঞ্জে রিং হয়েছে কিন্তু কোন উত্তর পাননি। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে বলতে থাকেন ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি … ’ বলতে বলতেই পিছনের জানালায় গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। জনাব ইসলামের হাত রক্তাক্ত হয়ে যায়- বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়তে বলেন তাকে ইশারায়।

বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের ছেলে আবদুল পাঞ্জাবি এবং চশমা নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু সেখানে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পরেন এবং এরপর উপরে উঠে যান। কিছুক্ষণ পর শেখ কামাল নিচে নেমে আসেন। শেখ কামাল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিছুদিন পূর্বে শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি এ্যাথলেট সুলতানা পারভীন-কে বিয়ে করেন। হাতের মেহেদী তখনও শুকায়নি।
শেখ কামাল নিচে আসার পরই একজন কালো পোশাকধারী কামালের পায়ে গুলি করে।

পরবর্তীতে কালো পোশাকধারীরা শেখ কামালকে ব্রাশ ফায়ার করলে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। এরপর ঘাতকরা উপরে উঠে যায়। মহিতুল সাহেবরা গোলাগুলির শব্দ পায় এবং বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়। বঙ্গবন্ধু জানতে চান তাকে কোথায় যেতে হবে। প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করার সাহস পায়নি। পরবর্তীতে প্রচণ্ড ব্রাশফায়ারের শব্দ শোনা যায়।

কিছু সময়ের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে আসে দোতলায়। কিছুক্ষণ পর মেয়েদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় নিচতলা থেকে। পালাক্রমে কান্না এবং গুলির শব্দ শোনা যায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে গুলি এবং কান্নার শব্দ শোনা যায়- তারপর এক সময় কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসেরকে নিচে নামানো হয়। নিচে অফিসের পাশে বাথরুমে নিয়ে তাঁকে গুলি করা হয়।

কিছুক্ষণ পর শেখ নাসেরের কণ্ঠে ‘পানি, পানি’ বলে আর্তনাদ শোনা যায়। পূর্বের সেই ঘাতক পানির পরিবর্তে তাঁকে পুনরায় গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সে মুহূর্তে বাকি আছে ছোট্ট রাসেল। রাসেলকে নিচে নামিয়ে আনে। ছোট্ট রাসেল মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে- আর জিজ্ঞাস করে ওরাতো আমাকে মেরে ফেলবে না? আমি আর কোনদিন এ বাড়িতে আসবো না।

পরে একজন ঘাতক শেখ রাসেলকে প্রধান গেটের কাছে পুলিশ বাঙ্কারে আটকে রাখে। রাসেল মা মা বলে কাঁদতে থাকে এবং বলতে থাকে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও। এরপর রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপরে নিয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ পাওয়া যায়। জনাব মহিতুল ইসলাম বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের ছোট্ট ছেলেটি আর নেই।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানোর জন্য ছুটে আসেন কর্ণেল জামিল। তাঁকে হত্যা করা হয় সোবহানবাগ মসজিদের কাছে এবং তাঁর মৃতদেহ তাঁর গাড়িতে রাখা হয়েছিলো। রক্তাক্ত অবস্থায় মহিতুল ইসলাম ও আবদুলকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং বাসায় আর কি ঘটেছিল তা জনাব ইসলাম জানতে পারেননি।

স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে যিনি বাংলার মানুষের কাছে এনে দিয়েছিলেন, তিনি ঘাতকদের হাতে বুলেটের গুলিতে নিহত হন। ঘাতকদের কারণে বাংলাদেশ হারালো তার জাতির পিতাকে আর বাঙালি হয়ে পড়লো অভিভাবকহীন। শোকের মাস আগস্ট। আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র: মামুন, মুনতাসীর (২০১২), বঙ্গবন্ধু কোষ, ঢাকা: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কোভিড-১৯ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. মোছা. ফেরদৌসী বেগম


বৈশ্বিক মহামারী COVI-19 এর আজ দুইশত বিশতম দিন। অবরুদ্ধ পৃথিবীবাসী আজ মুক্তি চায়। কিন্তু চাইলেই কি মুক্তি মেলে! বিশ্বায়নের যাত্রায় আজ শুধু আমার বলে কিছু নাই, সবই গ্লোবাল। তাই এ সময়ের মহামারী কোভিড-১৯ ও গ্লোবাল হয়েছে। চীন থেকে শুরু হলে ও এর ব্যাপ্তি এখন পৃথিবীময়।

ইতিহাস বলে পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রথম মহামারী ঘটেছিল চীনের হামিন মাঙ্গাতে ৫ হাজার বছর আগে। তখন চীনের ঐ একটি গ্রামের উনত্রিশটি পরিবারের দুইশত জনের সবাই মারা গিয়েছিল যা আজও পরিত্যাক্ত গ্রাম হিসেবে আছে। সেখানে কেউ বাস করে না।

মনে করা হয় যে এই জীবানুটি সিল্ক রুট অথবা সমুদ্রপথের মাধ্যমে যে বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক তৈরী হয়েছিল বা পৃথিবীতে প্রথম বিশ্বায়নের যে যাত্রা হয়েছিল তার মাধ্যমেই এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছে। বিশেষ করে মসলা ও শস্য যখন বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সাথে রডেন্ট বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণী এই জীবানুটি নিয়ে যায়। ষষ্ঠ শতকে জাস্টিনিয়ান প্লেগ বা প্রথম বিউবুনিক মহামারী ঘটেছিল তাI এই জীবানু দ্বারা।

এদের মধ্যে জিনগত সাদৃশ্যও আছে। এই জীবানুটি রোমান সম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ধবংস করেছিল রোমের আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থা। চতুর্দশ শতকেও একই জীবানু ব্ল্যাক ডেথ বা বিউবুনিক প্লেগ ঘটিয়েছিল এবং এ মহামারীতে পৃথিবীতে দুইশত মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।

এ মহামারীর ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে লাশ সৎকারের লোক পাওয়া যেত না। এটি পুরো ইউরোপের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের ইটালিয়ান প্লেগ ও লন্ডন প্লেগ নামে আরো দুটি মহামারী দেখা যায়। লন্ডন প্লেগের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে ডাক্তার, বিভিন্ন পেশাজীবির মানুষরা শহর থেকে পলায়ন করতে থাকে। এই সময়েই লকডাউন প্রথা চালু হয়।

সরকারীভাবে বাড়ী বাড়ীতে খাবার পৌছে দেওয়া হতো, মৃতদেহগুলোকে নির্দিষ্ট স্হানে সৎকার করা হতো। তখন পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এই প্লেগ থেকে পরিত্রানের জন্য লন্ডন শহরে আক্রান্ত এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং এ আগুন চারদিন স্হায়ী ছিল যা ইতিহাসে ‘গ্রেট ফায়ার অফ লন্ডনস’ নামে পরিচিত।

কোয়ারেন্টাইন ব্যাবস্হাও তখন থেকে চালু হয়। বিশেষ করে সংক্রমিত এলাকা থেকে কোন জাহাজ আসলে ভ্যানিস পোর্টে চল্লিশ দিন রেখে দেওয়া হতো। কোয়ারেন্টাইন শব্দটিও ইটালিয়ান শব্দ যার অর্থ চল্লিশ দিন৷ তখনও আধুনিক চিকিৎসা শুরু হয়নি, ইউনানি, হারবাল এসব চিকিৎসার চল ছিল।

মনে করা হতো এসব রোগ দূষিত বায়ুর কারনে ঘটে, তাপ বা স্মোক দ্বারা শুদ্ধ করা যাবে। সেজন্য বাচ্চাদেরকে পর্যন্ত স্মোক করতে উদ্বুদ্ধ করা হতো। ১৭২০-১৭২৩ পর্যন্ত ফ্রান্সের মারসিলিতেও একটি ভয়াবহ প্লেগ হয়েছিল। এ রোগের জীবাণুটিও পণ্যবাহী জাহাজে রডেন্টদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই এসেছিল। ঐ জাহাজকে চল্লিশদিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল তারপরও ইদুঁর বা রডেন্ট এর মাধ্যমে নগরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক লাখ লোক এতে মারা যায়।

এরপর ১৮৮৫ তে চায়না ও ইন্দোনেশিয়াতে একই ধরনের প্লেগ দেখা যায় এবং বারো মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এই যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে মহামারীগুলোর কথা এখানে উল্লেখ করা হলো তার সবগুলো কিন্তু ঘটেছিল একটিমাত্র ব্যাকটেরিয়াল জীবানু Yersinia pestis এর মাধ্যমে. তার অর্থ এই নয় যে শুধুমাত্র এই একটি জীবানুই পৃথিবীতে ছিল।

ঐ সময়ে আরো বেশ কিছু আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মহামারি ঘটেছিল বিভিন্ন জীবাণু দ্বারা। শুধুমাত্র একটি জীবাণুর রোগ আক্রমণের ক্ষমতা কতটা তীব্র হতে পারে তা এখান থেকে উপলব্ধি করার জন্য তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে এরকম জীবাণুর সংখ্যা চৌদ্দশতকের উপরে এবং মিউটেশন ও ক্রমাগত হোস্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আরও নতুন নতুন গুণ সম্পন্ন জীবাণুর উদ্ভব হচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে রোগের ধরন।

উনিশ শতক পর্যন্ত স্মলপক্স, কলেরা, টাইফয়েড, যক্ষা, কুষ্ঠ, মিজেলস্ প্রভৃতি রোগগুলো বিভিন্ন সময়ে মহামারী আকারে দেখা দিত এ রোগগুলোকে বলা হয় ক্ল্যাসিক্যাল রোগ। এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগগুলো বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তৈরীকৃত সালফা ড্রাগ, আর্সেনিক ড্রাগ, এন্টিবায়োটিক এগুলো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এর আগ পর্যন্ত পৃথিবীতে এ ধরনের কোন ড্রাগ না থাকায় মহামারীগুলো নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অসম্ভব। বাস্তবতা হলো আমরা রোগ নিয়ন্ত্রেনে এন্ট্রিবায়োটিক এত বেশি ব্যবহার করেছি যে

এ প্রভূত্বের মাত্র একশত বছর পার
না করতেই জীবাণুগুলো এন্টিবায়োটিকস রেজিস্ট্যান্স হয়ে তা আবার সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমাদেরই ঘাড়ে চেপে বসতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামি পঁচিশ বছরের মধ্যে যক্ষ্মসহ আরো কিছু রোগ আর প্রচলিত ড্রাগে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হবে না। অবস্থা হবে ভয়াবহ। প্রশ্ন হলো তাহলে কি আবার ইতিহাসের পূণরাবৃত্তি ঘটবে? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে নিশ্চয়ই নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটবে।

আবার গত দুই দশক ধরে মানুষের মধ্যে নতুন কিছু রোগ দেখা যাচ্ছে যা আগে পৃথিবীতে ছিল না যেমন এইডস, ইবোলা, বার্ড ফ্লু, সার্স, মার্স, কভিড-১৯ নানা ধরনের রোগ। শুধুমাত্র ১৯৪০-২০০৪ এ সময়ের মধ্যে গ্লোবালি তিনশত পয়ত্রিশটি সংক্রামক রোগের উদ্ভব ঘটেছে। এশিয়া-প্যাশিফিক অঞ্চল নোভেল ভাইরাস ইমার্জিন এর গ্লোবাল হট স্পটে পরিণত হচ্ছে। অত্র এলাকার মানুষের খাদ্যাভাস, জীবনযাত্রা, এনিম্যাল ফার্মিং প্যাটার্ণ এগুলোর একটা মারাত্মক প্রভাব থাকতে পারে।

ভাইরাস ঘটিত এ রোগগুলো কিন্তু ড্রাগ দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়, প্রয়োজন ভ্যাক্সিন। এই ভ্যাক্সিন দিয়েই উনিশ শতকে গুটি বসন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। আবার বিগত একশত বছরে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিভিন্ন সাবটাইপ স্প্যানিশ ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, হংকং ফ্লু, বার্ড ফ্লু ও সোয়াইন ফ্লুর মতো পাঁচটি মহামারী সৃষ্টি করেছে, তবুও আজ পর্যন্ত কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিস্কৃত হয়নি। বাজারে যে ফ্লু ভ্যাকসিন পাওয়া যায় তা শুধুমাত্র কিছু সিজিওনাল বা রিজিওনাল ফ্লু ভাইরাসের উপর কাজ করে এবং কার্যকারিতা দুই বছরের বেশী নয়।

এজন্য ভ্যক্সিন থাকা সত্বেও পৃথিবীতে আমরা ইনফ্লুয়েন্জা ভাইরাস ঘটিত ফ্লু দেখতে পাই। এ রোগে তেমন ঔষধও লাগে না শুধু বিশ্রাম, লেবুর শরবত, এমেনটিডিন, প্যারাসিটামল এগুলোতেই ভালো হয়ে যায়। কারন শত বছরব্যাপী বা তারও বেশি সময় ধরে মানুষের দেহে ফ্লু ভাইরাসের বিরুদ্ধে একটি স্ট্রং ইমুউনিটি বা হার্ড ইমুউনিটি তৈরী হয়েছে যা এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। এজন্য পুরোপৃথিবীর সত্তর থেকে আশিভাগ জনগোষ্ঠীকে সংক্রমিত হতে হয়েছে।

আজকের কোভিড-১৯ আক্রান্ত পৃথিবীর এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে হার্ড ইমুউনিটি তৈরী হতে পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। একটি এলাকা বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার্ড ইমুউনিটি তৈরী হলেও হবেনা কারন গ্লোবালাইজেশন এর এ সময়ে প্রতিটি রাষ্ট্র এখন আর্থ-সামাজিকভাবে প্রচন্ড রকমের আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। ফলে নভেল করোনা ভাইরাসের ট্রান্সমিশন ও রিপিটেড ইনফেকশশনের ঝুঁকিও অনেক বেশি।

মানুষ জম্ম থেকেই জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে কিছু ভাইরাস এনিম্যাল থেকে মানুষের দেহে জাম্প করছে। মানষের ভাইরাস ঘটিত যে রোগগুলো আছে তার ৮০% এসেছে এনিম্যাল থেকে আর কিছু এসেছে প্রাইমেট বা পূ্র্বপূরুষ থেকে। দেখা গেছে যে একটি ভাইরাস যখন স্পিসিস বেরিয়ার অতিক্রম করে এবং মানুষকে আক্রমণ করে তখন সেটি মারাত্মক হতে পারে।

যেমন বার্ড বা পিগ থেকে ইনফ্লুয়েন্জা ভাইরাস, শিম্পান্জি থেকে এইচআইভি, বন্য প্রানী থেকে ইবোলা, বাঁদুর থেকে সার্স ও কোভিড-১৯ এর ভাইরাস এসেছে। আবার বাঁদুর থেকে ঊট, ঊট থেকে মার্স এর জীবানু এসেছিল। ফার্ম এনিম্যাল ও ডমেস্টিক এনিম্যাল ভাইরাসের সব চেয়ে বড় উৎস। এই এনিম্যালগুলো প্যাথোজেনের অল্টারনেটিভ বা সেকেন্ডারি হোস্ট হিসেবে কাজ করতে পারে।

এদের মাধ্যমেও রিপিটেড মহামারী দেখা দিতে পারে। করোনা ভাইরাসটি পৃথিবীতে নতুন নয়। বর্তমান করোনা ভাইরাসের পূর্বপাদ (ancestor) এর অস্তিত্ব ছিল ৫৫ মিলিয়ন বছর আগে যা বাদুর ও পাখির সাথে সহ-অভিব্যাক্তির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে। করোনা ভাইরাসটি প্রথম সনাক্ত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে চিকেন এর দেহে। পরে মানষের দেহে সনাক্ত হয় ১৯৬০ এর দশকে। প্রথম দিকে মানুষের দেহে রোগ সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাস খুব বেশি ভিরুলেন্ট ছিল না।

এপর্যন্ত মানুষকে আক্রমণকারী সাতটি করোনা ভাইরাস আবিস্কৃত হয়েছে। এর মধ্য চারটি সাধারন কোল্ড এর মতো মৃদু সংক্রমণ এবং বাকি তিনটি SARS CoV, MERS CoV ও SARS CoV2 তীব্র সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ২০০২ সালে SARS CoV ভাইরাস সার্স ও ২০১৫ সালে MERS CoV ভাইরাস মার্স মহামারী ও নভেল করোনা ভাইরাস (SAR CoV 2) এ সময়ের বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ সৃষ্টি করেছে।

দেখা গেছে করনা ভাইরাসের চারটি গনের মধ্যে আলফা ও বিটা স্তন্যপায়ী প্রানি যেমন মানুষ সহ বাদুর, উট,গবাদি পশু, বিড়াল, ইদুঁর এর দেহে এবং গামা ও ডেল্টা পাখি ও মাছের দেহে থাকে। মানুষ যদি দীর্ঘদিন এই প্রাণীগুলোর ক্লোজ কনটাক্টে থাকে তখন সহজেই ভাইরাসটি পরিবর্তিত হতে পারে এবং মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। আর মিউটেন্টটি যেহেতু একটি নভেল ভাইরাস তাই এর বিরুদ্ধে মানুষের পূর্ব থেকে ইমুউনিটি থাকে না।

আবার যদি এই ভাইরাস ভিরুলেন্ট হয় এবং মানুষের দেহে স্টাবলিশ করতে পারে তাহলে সর্বোচ্চ সংক্রমণ বা মাস পপুলেশনের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। ক্রমাগত সংক্রমণ ঘটিয়ে মহামারী সৃষ্টি করতে পারে। আবার একইভাবে অনেকগুলো লাইফ সাইকেল অতিক্রম করে নিজেরা ও দূর্বল হতে পারে।

কিন্তু সমস্যা হলো একাধিক হোস্ট থাকা যা থেকে আরো নতুন নতুন সাবটাইপ তৈরী হতে পারে। যেমনটি আমরা ইনফ্লুয়েন্জাতে দেখতে পাই। ভাইরাসটি পিগ ও পাখি থেকে মানুষে জাম্প করেছে এবং বার বার মহামারী সৃষ্টি করছে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবণাটি প্রকট। হতে পারে আট দশ বছর পরপর একটি নভেল করোনা সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারী যা একবিংশ শতাব্দী জুড়েই চলতে পারে। এ সম্ভাবণাকে কোনভাবেই নাকচ করা যাবেনা।

COVID-19 সৃষ্টিকারী নভেল করোনা (SARS CoV2) ভাইরাসটি একটি একক স্ট্রান্ড আরএনএ যুক্ত এনভেলপড ভাইরাস। এর ৩০০০০টি নাইট্রোজেন বেস ও ২৮ ধরনের প্রোটিন আছে। শুধু স্পাইক প্রোটিনে আছে ১২৭৪ টি আ্যামাইনো এসিড। এনভেলপের বাইরের দিকে স্পাইকগুলো বিন্যস্ত থাকে। তিনটি করে স্পাইক একসাথে থেকে ক্রাউনের মতো স্ট্রাকচার তৈরী করে সেজন্য নামকরন হয়েছে করোনা।

ইনফ্লুয়েন্জা, এইচআইভি, করোনা এগুলো স্পাইক যুক্ত এনভেলপড ভাইরাস। এদের আর্কিস্ট্রাকচারাল ডিজাইন যতটাই সুন্দর এরা ততটাই ডেন্জারাস। এই স্পাইকগুলো হলো এন্টিজেন। এদের রাসায়নিক গঠন উপাদানের সামান্য পরিবর্তনে একটা নতুন মিউটেন্ট বা সেরোটাইপ তৈরী হতে পারে। যতবেশি সরোটাইপ তৈরী হবে ভ্যাকসিন এর জন্য তত প্রতিবন্ধকতা তৈরী হবে।

করোনা ভাইরাসটিও ইতিমধ্যে অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ৬৮,৬৮৮ টি করোনা স্ট্রেন এর জিনোম সিকুয়েন্স করা হয়েছে। এর মধ্যে ডি৬১৪জি মিউটেন্টটি বাংলাদেশে বেশি সক্রিয়। ইতিমধ্যে স্ট্রেনটির জিনোমিক পর্যায়ে ৫৯০টি ও আ্যামাইনো এসিড পর্যায়ে ২৭৩টি পরিবর্তন ঘটেছে।

বাংলাদেশে সক্রিয় স্ট্রেনটির স্পাইক প্রোটিনে ৩৬টি আ্যামাইনো এসিড পরিবর্তিত হয়য়েছে। যেসকল দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমনের হার বেশি ছিল সেখানে ভাইরাসটির জিনে ৩৪৬-৫১২ নম্বর ধারা মারাত্মকভাবে সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশে এইধরনের মিউটেন্ট দেখা যায় নাই। এদিক দিয়ে আমরা ভাগ্যবান। আবার ভারতের এক রিপোর্টে দেখা গেছে যে ২৩-২৫% মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এন্টিবডি ডেভেলপ করেছে এবং সম পরিমান এফেক্টেটেট হয়েছে। আর্থাৎ আমরা হার্ড ইমুউনিটির দিকে এগুচ্ছি। হয়তো আমরা খুব নিকট ভবিষ্যতে এ সংকট কাটিয়ে উঠবো কিন্তু অনাগত ভবিষ্যত শংকা মুক্ত হবে না।

ভাইরাস ঘটিত রোগের একমাত্র প্রতিরোধক ভ্যাকসিন । কিন্তু‘ সকল রোগের ভ্যাক্সিন তৈরী করা সম্ভব হয়নি বা হলেও তার কার্যকারিতা সমান নয়। এর কারন হলো জীবানুগুলোর এন্টিজেনিক ভিন্নতা বা একাধিক সেরোটাইপ থাকা বা একই প্যাথোজেনের একাধিক পোষক থাকা ইত্যাদি। আর ঠিক একারনে এইডস বা ইনফ্লুয়েঞ্জার কার্যকরী বা দীর্ঘ মেয়াদী ভ্যাকসিন তৈরী হয়নি। সাধারনত যে সমস্ত ভাইরাসের মিউটেশনের ফ্রিকুয়েন্সি বেশি তার এন্টেজিনিক বৈশিষট্যগুলোও দ্রুত পরিবর্তন হয়।

এই পরিবর্তনটার জন্য ভাইরাসটি অধিকতর সংক্রমণশিল হতে পারে বা রোগ আক্রমণের ক্ষমতা হারাতে পারে। বিভিন্ন প্যাথোজেনের এন্টেজেনিক প্রোপার্টিজ বিভিন্ন রকমের যেমন ভাইরাসের ক্ষেত্রে ক্যাপসিড, এনভেলপ বা স্পাইক আবার ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে টক্সিন, ক্যাপ্সুল বা কোষ প্রাচীর। প্রতিটি এন্টিজেনের আবার সুনির্দিষ্ট বাইন্ডিংসাইট আছে যাকে এপিটপস্ বলে যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পোষক দেহে অবস্থিত একটি কম্পলিমেরি রিসেপ্টরের সাথেই যুক্ত হতে পারে।

এ দুটো ম্যাচ না করলে প্যাথোজেন কখনই পোষকদেহে স্টাবলিশ করতে পারেনা বা রোগ সৃষ্টি করতে পারেনা। কিন্তু COVID-19 সৃষ্টিকারী নোভেল করোনা ভাইরাসের বাইন্ডিংসাইট স্পাইক প্রোটিনে দুটি সাব ইউনিট S1ও S2 থাকে। S1 এর দুটি রিজিওন S1-NTD ও S1-CTD আছে যা পোষক কোষের এক বা একাধিক রিসিপ্টরসাইট যেমন ACE2, APN, DPP4 এর সাথে যুক্ত হতে পারে।

এগুলো সাধারনত মানুষের শ্বাসযন্ত্র, অন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্রসহ বিভিন্ন অঙ্গের কোষে থাকে। ফলে COVID-19 এ আক্রান্ত রোগির শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা ছাড়াও ডায়রিয়া, স্বাদহীনতা, গন্ধহীনতা, কিডনিফেইলিওরসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় অর্থাৎ মাল্টিঅর্গান ডিজঅর্ডার দেখা দেয়। যেহেতু এখনও ভ্যাকসিন আবিস্কার হয় নাই তাই সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দেখা গেছে এন্টিম্যালেরিয়াল ও এন্টিভাইরাল ড্রাগ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর। মহামারীর শুরুর দিকে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় chloroquine ও azithromycine দেওয়া হতো। পরে ডেঙ্গু চিকিৎসার এন্টিভাইরাল ড্রাগ ivarmectin ব্যবহার করা হয়। ইবোলা, সার্স ও মার্স ভাইরাসে ব্যবহৃত এন্টিভাইরাল ড্রাগ remdesivir ও বেশ কার্যকর।

আবার এইডসে ব্যবহৃত lopinavir ও ritonavir এককভাবে খুব একটা কার্যকর নয় কিনতু ফ্লু ড্রাগ oseltamivir এর সাথে কম্বাইন্ডলি বেশ কার্যকর। সেকেন্ডারী ইনফেকশন রোধে অ্যাজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রয়োজনবোধে এন্টিব্লাডক্লটিং ড্রাগ, ভেন্টিলেশন, প্লাজমা থেরাপী, এন্টিবডি থেরাপী দ্বারা নানাভাবে ঈঙঠওউ-১৯ মোকাবেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন এর হিউম্যান ট্রায়াল চলছে। বিশ্ববাশী তাকিয়ে আছে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের আশায়। কিন্তু রোগ প্রতিকার এর সাথে প্রতিরোধ ব্যবস্হাও জোরদার থাকতে হবে। সেজন্য প্রচলিত ব্যবস্হা সাবান পানিতে হাত ধোয়া, মাস্ক পরিধান করা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, পাবলিক প্লেস বা জনসমাগম এড়িয়ে চলা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, সংক্রমণ হলে অইসোলেশনে থাকা এগুলো মানতে হবে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ব্যবহৃত বর্জ্য যেমন মাস্ক, পিপিই, গ্লভস এগুলোকে ঠিকমতো ডিজপজ করতে হবে না হলে এগুলোও হতে পার সংক্রমন এর উৎস।

করোনা ভাইরাস জীবানুটি যেহেতু খুব ছোট (১২৫nm) তাই আক্রান্ত ব্যাক্তির হাচি, কাশি, কথাবলার সময় জলবিন্দুর (water droplets ) সাথে বেরিয়ে আসে ও বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। রুমের ডাস্ট পার্টিক্যালকে সাপোর্ট করে দীর্ঘ সময় বাতাসে টিকে থাকতে পারে এবং এক সময় ফ্লোরে জমা হবে। আবার ঘর ঝাড়ু বা বিভিন্ন মুভমেন্ট এর সময় রুমে আবার সার্কুলেট হবে।

এজন্য ফ্লোর ক্লিনিং এর সময় অবশ্যই ডিজইনফেকটেন্ট ব্যবহার করতে হব। রুমের দরজা জানালা খুলতে হবে এবং সূর্যের আলো আসতে দিতে হবে। এতে করে রুম অভ্যন্তরে ভাইরাল লোড কম হবে এবং সূর্যের আলোর সাথে যে uv-ray আসবে তাতে কিছু ভাইরাস মারা যাবে। রুমে এয়ার পিউরিফায়ার লাগানো যেতে পারে, ডিসইনফেক্ট্যান্ট স্প্রে করা যেতে পারে। আবার সনাতনি পদ্ধতিতে স্মোক বা আগরবাতিও ব্যবহার করতে পারি। এগুলো ভালো এয়ার পিউরিফায়ার। নিজগৃহকে জীবাণু মুক্ত রাখতে হবে। এ্যাপার্টমেন্ট এর লিফট, সুপার মল, যেকোন এসি মার্কেট, এসিবাস, বিমান এ সমস্ত জায়গায় তাপমাত্রা অনুকূল থাকায় ভাইরাস অধিক সময় টিকে থাকতে পারে। তাই এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ।

মনে রাখতে হবে কেবল সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ দূ্র্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব। জীবানুরা হেরে গেলে মানুষ জিতে যায় আর মানুষ জিতে গেলে জীবানুরা হেরে যায়। জীবানুরা যেমন অনেক মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে তেমনি মানুষও জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রতিটি মহামারী আমাদের শিখিয়েছে অনেক কিছু।

স্যানিটেশন ব্যাবস্থা, জীবানুনাশক, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, এন্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন ইত্যাদি ব্যাবহার করতে শিখেছি। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর কারনেও আমাদের চিরচেনা পৃথিবী ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। মানুষের জীবন, জীবিকা ও আর্থ- সামাজিক অবস্হা পাল্টে যাচ্ছে্। আমাদের জীবনাচাণরও অনেক পরিবর্তন ঘটবে।

ইনফ্লুয়েন্জার মতো কোভিড-১৯ ও একটি পরিচিত ও সিজিওনাল অসুখ হিসেবেই বিরাজ করবে পৃথিবীতে। তবে ভয় পেলে চলবে না। এখন আমাদের টিকে থাকাটাই আসল কথা- আর তার জন্য সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।

লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী

 

তাসফীর ইসলাম


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯০তম জন্মবার্ষিকী শনিবার (০৮ আগস্ট)।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর এসব লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলনের নেপথ্যের প্রেরণাদাত্রী ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি বঙ্গবন্ধুর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করে তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে ছিলেন।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বিশ্বে যা কিছু চির সুন্দর, কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ’ বেগম মুজিবের জীবনী বিশ্লেষণে বিদ্রোহী কবির এই কবিতার যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায়।

বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়-দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বার বার পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বন্দি জীবন-যাপন করছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদের বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতেন।

বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে কিছু কুচক্রী স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপন্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো, তখন প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার ডাকনাম ছিল রেণু। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট।

এই মহীয়সী নারী ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সপরিবারে স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খুনিচক্রের বুলেটের আঘাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।

লাখো মানুষের রক্তের যোগানদাতার অনবদ্য নাম “বাঁধন”

মাজেদুল ইসলাম


একের রক্ত অন্যর জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন -স্লোগানে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৯৭ সালের ২৪ ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় স্বেচ্চায় রক্তদানকারী প্লাটফর্ম “বাঁধন” সংগঠনটি।

সেদিনের সেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে উঠা ছোট্ট সংগঠনটি আজ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতার রক্ত পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থলের নাম।এখন আর সংগঠনটি শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না বরং এর বিস্তৃতি এখন প্রায় সারাদেশেই।

সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৫৩ টা জেলায় ৭৫ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১৩৬ টি ইউনিট ১২ টি জোন এবং ৭ টি পরিবার নিয়ে গঠিত এ সংগঠনটি।

দীর্ঘ ২৩ বছরের পরিক্রমায় প্রায় ৯৫০৮৩৫ জন মানুষের বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করিয়ে জনমানুষের মধ্য রক্ত দান ও গ্রহনের উপকারিতা বুঝিয়ে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করেছে সংগঠনের নিবেদিত প্রাণ সদস্যবৃন্দ।প্রায় ২০ হাজারের ও বেশি বাঁধনকর্মী সেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম ছাড়াও করোনা মোকাবেলায় প্লাজমা দানে উৎসাহিত করেছে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০-১২ লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। ২০১৮-১৯ এ প্রায় ৭৫০০০ ব্যাগ রক্তের যোগান দিয়ে সংগঠনটি।
বাঁধনের কেন্দ্রীয় কমিটির চৌকস সদস্যগুলোর সুদক্ষ কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় প্রায় ১০ লক্ষ রক্ত যোগানের দিকেই হাটছে বাঁধন গ্রুপ।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে, বাঁধনের কার্যক্রমকে বেগবান করতে গতকাল ৬ ই আগস্ট সন্ধা ৭ টা থেকে ৯ টা জুম অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইন সেমিনার করে বাঁধনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়।

বাঁধনের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সনজিত কুমারের সভাপতিত্বে উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য উপাচার্য প্রফেসর ড.কামাল উদ্দিন আহমেদ,বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড.মোঃজসিম উদ্দীন খান এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড.আমির হোসেন।

উক্ত সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মশিউর রহমান সূর্যকে সভাপতি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহিদুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাবি, রাবি, শেকৃবি, জাবি, জবি, বাকৃবি সহ বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ গুলোর বাঁধনকর্মী নিয়ে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ ২০২০-২০২১ গঠন করে।

বাঁধন হয়ে উঠুক কোটি মানুষের আস্হার প্রতীক রক্তদানে অনবদ্য প্লাটফর্ম।

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা

অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহা


বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান
মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।

© কাজী নজরুল ইসলাম।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরস্পর অবিচ্ছেদ্য নাম। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে পরিবারের সহযোগিতা বিশেষ করে স্ত্রীর অবদান অনস্বীকার্য।

মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হচ্ছেন বঙ্গমাতা। ফজিলাতুন্নেছার বাবা মারা যাওয়ার পরে তিন বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। পাঁচ বছর বয়সে রেণু তাঁর মাকে হারায়। পিতা-মাতা হারা রেণু বঙ্গবন্ধু’র পিতা শেখ লুৎফর রহমান আর মাতা সায়েরা খাতুনের আদরে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য ভাই- বোনের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠেন।

বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, তাঁদের বিয়ের ফুলশয্যা হয়েছিলো ১৯৪২ সালে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তঁার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে বঙ্গমাতা নিজেকে যুক্ত করেন।

বঙ্গমাতা নিজের গহনা বিক্রি করে ছাত্রলীগের সম্মেলনে টাকা দিয়েছেন। ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অর্থ ও পরামর্শ দিয়ে দলকে পরিচালনা করতেন। আব্দুর রাজ্জাকের একটি লেখায় পড়েছি- আওয়ামী লীগের অফিসের ভাড়া এবং তাঁর নিজের বাসার ভাড়া দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য না থাকার কারণে বঙ্গমাতা- অফিসের ভাড়া এবং মরহুম রাজ্জাক সাহেবের বাড়ি ভাড়ার টাকাও বঙ্গমাতা জুগিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে বঙ্গমাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার কতর্ৃক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়।

এমনকি বেগম মুজিবকে গ্রেফতার করার হুমকিও দেয়া হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন সংঘটিত হয়। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রণ জানায়। বেগম মুজিব জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্যারোলে মুক্তি নেয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।

সত্যি সত্যিই গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের প্রিয় নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। সে সময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন জনাব তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদের মুখে প্রথম উচ্চারিত হয়েছিলো ‘বঙ্গবন্ধু’।

সেই থেকে শেখ মুজিব বাঙালির দেয়া খেতাব বঙ্গবন্ধু-তে পরিণত হন। বেগম মুজিব প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে জোড়ালো আপত্তি না করলে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হতো না।

আমরা প্রায় সবাই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা জানি। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর উপর স্বাধীনতা ঘোষণার একটি চাপ ছিলো, অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের কড়া দৃষ্টি ছিলো। আমরা অনেকেই জানি সেই ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে মাথার উপর সুসজ্জিত হেলিকপ্টার ঘুরছে, আর মঞ্চের চারপাশে সাদা পোশাকে পাকিস্তানী আর্মি বঙ্গবন্ধুর উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। সকল বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণা চেয়েছিলো। অথচ বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতার ডাক দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত হতেন।

এমন একটি সময় বেগম মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। বেগম মুজিব জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে এবং সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে মন থেকে যা বলতে ইচ্ছা করে- তাই বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তঁার পরামর্শের যথার্থ প্রতিফলন দেখা যায় ঐতিহাসিক এ ভাষণে। বঙ্গমাতা উল্লিখিত দু’টি ঘটনায় প্রত্যক্ষ অবদান যদি না রাখতেন, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে অবদান- সেখানে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার সহযোগিতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ৮ই আগস্ট বঙ্গমাতার ৯০তম জন্মবার্ষিকী। আমাদের শ্রদ্ধা আর অফুরন্ত ভালোবাসা রইলো তঁার প্রতি।

লেখক: উপ-উপাচার্য
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কোয়ারেন্টাইনে শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের দায়িত্ব

 

বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় অনেক দেশেই করোনা আঘাত হানছে। ফলে সারা পৃথিবীতে ছয় লক্ষের ও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের মানুষ গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে।

মানুষের অনেক কাজে শিথিলতা আসলেও থেমে থাকছে না শিশুদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া।
কারণ এটি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।

অনেক শিশু আছে যাদের স্কুলে যাওয়ার মতো বয়স হয়েছে কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারনে তা সম্ভব হচ্ছে না।আবার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ফিরতে পারছে না তাদের বিদ্যাপিঠে।শুধু যে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত তা না বরং বিনোদন থেকেও বঞ্চিত।আমরা যারা অভিভাবক তারা যেন শিশুদের ব্যাপারে একটু সতর্ক হই বিশেষ করে তাদের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি।

শিশুরা যেন বাড়িতে বসেই শিক্ষালাভ ও বিনোদনের সুবিধা পায় সেই বিষয়টি গভীরভাবে দেখা প্রয়োজন।আমরা যেমন করোনার আপডেট শুনে বিচলিত হই বা ভয় করি, তেমনি শিশুরাও কিন্তু ভয় করে।কোনো ভাবেই শিশুদের সামনে সেই আপডেট বলা যাবে না কারণ তারা তাদের অবচেতন মনে অনেক কষ্ট পায়।অবিভাবক হিসেবে শিশুদের প্রতি মায়েদের দায়িত্বটা একটু বেশি।মায়েরা বাড়িতে বসেই যেন পড়াশোনার ব্যাপারটা নিশ্চত করে।

কারণ দীর্ঘদিন পড়াশোনা বন্ধ রাখলে তারা নিজেকে ছাত্র মনে করবে না! এমনকি আগে যেটুকু পড়াশোনা করছে সেটাও ভুলে যাবে।আবার বিনোদন হিসেবে কিছু সময় টিভি দেখা,একটু খেলাধুলা করা এমনকি ব্যায়াম করার মাধ্যমেও তা করতে পারে।আর বিনোদনের পাশাপাশি পড়াশোনাটাকে চালিয়ে নেওয়ার চেস্টা করবেন।এ ক্ষেত্রে পুরষ্কারের ব্যবস্হা করতে পারেন।

কখনোই শিশুদের রাগান্বিত ভাবে কথা বলবেন না।বুঝানোর চেস্টা করবেন শিশুদের।শিশুদের কোমলমতি মন যেন ভেঙে না যায় অভিভাবকের কোন বিরুপ আচরণে।

তবে বিনোদন হিসেবে আপনাদের হাতের অ্যানড্রয়েট সেটটি দিবেন না, কারন এতে আসক্ত হতে সময় লাগবে না।আর একবার আসক্ত হলে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে দাড়াবে।এছাড়া শিশুদের পুষ্টিকর খাবার ও নিশ্চিত করতে হবে তবেই শিশুরা খুব ভালো ভাবেই বেড়ে উঠবে।

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধার।তাই শিশুদের সামাজিক ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা প্রত্যেকটা নাগরিক তথা অভিভাবকের দায়িত্ব।

লেখক
মাসুম বিল্লাহ
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়